শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

উদ্বেগ ছড়াচ্ছে অবৈধ অস্ত্র

♦ তৈরি হচ্ছে দেশেই, মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ♦ গোয়েন্দারা ভাবনায়

সাখাওয়াত কাওসার

উদ্বেগ ছড়াচ্ছে অবৈধ অস্ত্র

১ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। রাজধানীর মাটিকাটা বাজারের পার্শ্ববর্তী ৫১/৫ পশ্চিম মাটিকাটার নির্মাণাধীন স্বর্ণালী টাওয়ার। হঠাৎ করেই পর পর কয়েকটি গুলির শব্দ। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে আশপাশ এলাকায়। মানুষজন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দিগবিদিক ছুটতে থাকেন। কিছু সময়ের মধ্যে হুইসেল বাজিয়ে ঘটে পুলিশের আগমন। আসলাম নামের একজনকে এলাকাবাসীর সহায়তায় একটি বিদেশি অস্ত্র ও তিন রাউন্ড গুলিসহ পাকড়াও করতে সক্ষম হয় তারা। পরে ক্যান্টনমেন্ট থানার উপপরিদর্শক হাসান পারভেজ বাদী হয়ে একটি মামলাও করেন।

স্থানীয়রা বলছিলেন, দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয় হিটলু ও জাহাঙ্গীর গ্রুপের ক্যাডাররা এই এলাকায় আধিপত্য ও চাঁদাবাজি নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটছে। তবে ক্যান্টনমেন্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহীনুর রহমান বলেন, এরা ভাড়াটিয়া হিসেবে কাজ করে। এদের অন্য কোনো পরিচয় নেই। ভাসানটেক এলাকাতেই এদের বিচরণ বেশি। আমরা আসলাম এবং জাহাঙ্গীর নামে দুজনকে গ্রেফতার করেছি। হিটলুকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। নিয়মিত টহলও অব্যাহত রয়েছে।

১০ মার্চ রবিবার ভোরের দিকে রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় মো. আলম (৪৮) নামের এক ট্রাকচালককে পায়ে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। গুলিবিদ্ধ আলম বলেন, এলাকায় দুই গ্রুপ সন্ত্রাসীর মধ্যে বিরোধ রয়েছে। আমি ট্রাকে করে সেখানে মাটি ফেলতে গেলে এক গ্রুপ আমাকে গুলি করে। এ সময় তারা আমাকে বলে ‘এলাকা ছেড়ে দ্রুত চলে যাবি। দেরি করলে গুলি করে দেব। কিন্তু আমাকে নিরাপদে যাওয়ার সময়ও দেয়নি তারা। এরই মধ্যে ওরা আমাকে গুলি করে দেয়।’

ওপরের মাত্র দুটি ঘটনা উল্লেখ করা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীসহ সারা দেশে মাঝেমধ্যেই এমন ঘটনা ঘটছে। মাঝে মাঝেই গুলির শব্দ শুনতে হবে- এ যেন রুটিনওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সাধারণ মানুষ। অনেকে অস্ত্রবাজদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দিতেও ভয় পান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অস্ত্রের নেপথ্য নায়কদের বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অবগত। তবু লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ তাদের অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জড়িত। এর বাইরে দেশেই উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্র তৈরির বিষয়টি রীতিমতো ভাবিয়ে তুলছে গোয়েন্দাদের।

৪ মার্চ সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শিক্ষক রায়হান শরীফ শ্রেণিকক্ষে আরাফাত আমিন নামের এক ছাত্রকে পায়ে গুলির ঘটনায় দেশব্যাপী রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি হয়। শিক্ষাঙ্গনের এহেন চিত্র কর্তৃপক্ষকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। পুলিশ বলছে, গ্রেফতার সেই শিক্ষকের কাছ থেকে এ পর্যন্ত দুটি বিদেশি পিস্তল, ৮১টি গুলি, চারটি ম্যাগাজিনসহ অন্যান্য সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় দুটি মামলা হয়েছে।

অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে দেখতে না পারলে কখনো অবস্থার পরিবর্তন হবে না। অবৈধ অস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে কীভাবে আসছে- এর প্রতিটি বিষয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো জানলেও প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এর বিপরীতে বাড়তে থাকবে সামাজিক অস্থিরতা। বিরূপ প্রভাব পড়বে পরিবার এমনকি রাষ্ট্রেও। ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়’ এর মতো।

১২ মার্চ রাজধানীর বাড্ডা থেকে গ্রেফতার দুই ব্যক্তির কাছ থেকে উদ্ধারকৃত পিস্তলের তথ্যে রীতিমতো চোখ কপালে উঠেছে র‌্যাব কর্মকর্তাদের। একে একে গ্রেফতার করা হয় অস্ত্র তৈরির কারিগর মো. মোখলেছুর রহমান সাগরসহ মোট ছয়জনকে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় চারটি পিস্তল, চার রাউন্ড কার্তুজসহ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম। একই সঙ্গে জব্দ করা হয় সাতটি পিস্তলের কাঠের ফর্মা, ১০টি ফায়ারিং ম্যাকানিজম, চারটি ট্রিগার, দুটি পিস্তলের হ্যান্ডগ্রিপ, দুটি ড্রিল বিট, ৫টি রেত, ৫০টি স্প্রিং, ৪০টি পিস্তলের নাট বল্টু, ২টি কম্পাস, ৩টি গাজ, ৪টি ক্লাম, ২টি ড্রিল মেশিন, ২টি বাইস, ১টি বার্নি স্কেল, ১টি মুগুর, ৪টি ক্লাম, ২০টি হেস্কো ফ্রেম, ২টি গোল্ড এলএস ফ্লাম, ১টি টুল বক্স, ১টি গ্যারেন্ডার মেশিন, ১টি কাঠের যোগান, ১টি হাতুরি, ৪টি শিরিস কাগজ। র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি ফরিদ উদ্দীন বলেন, অভিযানে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী চক্রটির হোতা অস্ত্র তৈরিকারী মো. মোখলেছুর রহমান সাগর ও মো. তানভির আহম্মেদ। এদের মধ্যে মো. মোখলেছুর রহমান সাগর অবৈধ অস্ত্র তৈরি ও অস্ত্র ব্যবসায়ী চক্রটির হোতা। সাগর দেশে এসে অস্ত্র তৈরি করে অল্প দিনে কোটিপতি হওয়ার আশায় অবৈধ অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করে। এরপর মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে সরবরাহের পরিকল্পনা করে। এরই অংশ হিসেবে প্রথমে সে তানভির, অনিক ও সৈকতদেরকে নিয়ে অস্ত্র তৈরি ও সরবরাহের জন্য একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। তিনি আরও বলেন, গ্রেফতার তানভির পেশায় একজন লেজার সিএনসি ডিজাইনার। লেজার সিএনসি ডিজাইনার হওয়ায় সে যে কোনো কিছু কম্পিউটারে (২উ) নকশা অনুযায়ী অত্যন্ত সূক্ষভাবে কাটিং করতে পারে। সাগরের দেওয়া নকশা অনুযায়ী তানভীর বিভিন্ন অস্ত্রের যন্ত্রাংশ তৈরির মাধ্যমে অস্ত্র তৈরির প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করত। এরা প্রতিটি পিস্তল/অস্ত্র ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক বিরোধ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা এবং অন্যান্য অপরাধমূলক ঘটনায় প্রকাশ্যে ও আড়ালে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। অস্ত্রধারীরা গ্রেফতার না হলে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। অস্ত্র উদ্ধারে সমন্বিত অভিযান চালাতে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার পুলিশের একটি রুটিন ওয়ার্ক। পুলিশ সব সময়ই এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। জানা গেছে, র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির অভিযানে গত ১৩ মাসে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই আগ্নেয়াস্ত্র। গত এক বছরে অবৈধ অস্ত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিসংখ্যান থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ২০২৩ সালে বিজিবি দেশের সীমান্তসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে গত বছর ১০৮টি আগ্নেয়াস্ত্র, সহস্রাধিক গুলি ও বিপুল বিস্ফোরক উদ্ধার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এ সময় ২ হাজার ২৮৮ কোটি ৬৬ লাখ ৭ হাজার টাকা মূল্যের মাদকসহ বিভিন্ন ধরনের চোরাচালান পণ্যসামগ্রী জব্দ করা হয়েছে। এসবের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে ২ হাজার ৩৬৭ জনকে গ্রেফতার করেছে বিজিবি। র‌্যাব ২০২৩ সালে সারা দেশ থেকে ৫৮১টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে। এ সময় গ্রেফতার করা হয় ২৬৬ জনকে। তবে পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া শাখায় কয়েক দফা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের পরিসংখ্যান চেয়ে ফোন এবং খুদেবার্তা পাঠালেও তা সরবরাহ করা হয়নি।

সাম্প্রতিক যত খুনের ঘটনা : ৭ মার্চ কক্সবাজারের উখিয়ায় আনোয়ারুল ইসলাম (৩৫) নামে এক যুবককে অবৈধ অস্ত্র দিয়ে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তিনি উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের রহমতের বিল গ্রামের আবদুস সালামের ছেলে। তিন সন্তানের জনক। ১৯ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাটের মোল্লাহাটে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই বংশের লোকজনের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে পান্না মোল্লা (৪৫) নামে একজন নিহত হয়েছেন। ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে ৬ পুলিশ সদস্যসহ দুই পক্ষের অন্তত ২৫ জন আহত হন। তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। বাগেরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেলুর রহমান বলেন, সংঘর্ষের সময় দেশি অস্ত্র ব্যবহার করে দুর্বৃত্তরা। গত ২৩ জানুয়ারি খুলনায় মাছ ব্যবসায়ী সাদেকুর রহমানকে (৩৬) গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিহত সাদেকুরের স্ত্রী হাবিবা রানু বাদী হয়ে সোনাডাঙ্গা থানায় মামলাটি করেন। ২৩ জানুয়ারি খুলনায় মাছ ব্যবসায়ী সাদেকুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গত জানুয়ারিতে কক্সবাজারের উখিয়ায় মো. হুজিত উল্লাহ নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি ফয়েজুল করিমের ছেলে। উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামীম হোসেন বলেন, একটি চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেওয়ার সময় হুজিত উল্লাহকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

সর্বশেষ খবর