শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

শেরে খোদা আলীকে স্মরণ করার মাস রমজান

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

শেরে খোদা আলীকে স্মরণ করার মাস রমজান

দূরের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটি দেখে সবার মন ভরে যায়। ফুলে ফলে নুয়ে পড়া গাছের নিজেরও ভালো লাগে। কেউ চলতে চলতে গাছের নিচে খানিক জিরিয়ে নেয়। কেউবা গাছের ডাল কেটে বাজারে বিক্রি করে পয়সা বানায়। এভাবেই চলছে, চলে যাচ্ছে। কিন্তু ভাবুক মন জানতে চায়, গাছটি বেঁচে আছে কীভাবে? মন উত্তর পেল, মাটির গভীরে শেকড় না থাকলে একদিনের মধ্যেই গাছের সবুজ পাতা হলদে হয়ে যাবে। গোড়ায় পানি না পেলে কয়েক দিনের মধ্যেই ধপাস করে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে গাছটি। ওই গাছটির মতই আমাদের ইসলাম। ফুলে ফলে সুশোভিত ইসলামে কেউ শান্তি খুঁজে পেয়েছে কেউবা আবার ইসলাম নিয়েই নানাভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছে। কিন্তু দুনিয়ার বুকে ইসলাম টিকে আছে কীভাবে? দয়াল নবিজির হাতে রোপন করা ইসলাম বৃক্ষ বেড়ে উঠেছে আবুবকর-ওমর-উসমান আর আলীর মত ত্যাগী সাহাবিদের অক্লান্ত পরিশ্রমে। ইসলাম বেঁচে আছে ফুরাতের তীরে ইমাম হোসাইনের (রা.) রক্তের নজরানার কল্যাণে। ইসলাম বৃক্ষের একটি শক্তিশালী শেকড় বিশ্বাসীদের অভিভাবক শেরে খোদা হজরত আলী (রা.)। রমজান এলেই আলী প্রেমিকদের দিলের দরিয়ায় কান্নার রোল উঠে। এ মাসের ২১ তারিখে দুশমনের ছুড়ির আঘাতে নির্মমভাবে শহিদ হন জ্ঞননগরীর দরজা মাওলায়ে কায়েনাত আলী (রা.)। আলী (রা.) এমন বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী যে, তিনিই একমাত্র শিশু-যার জন্ম হয়েছে কাবাঘরের ভেতরে। নবুওয়তের ১০ বছর আগে রজব মাসের ১৩ তারিখ মাওলা আলী মক্কার কাবা ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ইংরেজি বর্ষ মতে, ৬০১ সালের ১৫ সেপ্টম্বর আলীর (রা.) জন্ম। তার বাবার নাম আবু তালেব এবং মায়ের নাম ফাতেমা বিনতে আসাদ। রাসুল (সা.) এর আপন চাচাতো ভাই এবং খাতুনে জান্নাত মা ফাতেমার স্বামী তিনি। শিয়া মাজহাবের সূত্র মতে, আবু তালেব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কিন্তু সুন্নী সূত্রমতে, মৃত্যুর আগে তিনি জাহেলি ধর্মের ওপরই ছিলেন। তবে সুন্নী ও শিয়া সব ঐতিহাসিকই অকপটে স্বীকার করেছেন, ইসলাম প্রচারে আবু তালেবের সহযোগিতা ও আত্মত্যাগ রাসুলের জন্য ছিল অন্যন্য মাইলফক। কাফেররা বারবার মুহাম্মদকে তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য হুমকি ধমকি দিয়েছেন, তিন্তু আবু তালেব স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, আমার ভাতিজা কোনো অন্যায় করেনি। আমি বেঁচে থাকতে তার একটি পশমেরও ক্ষতি হতে দেবো না।’ বলছিলাম, আলীকে স্মরণ করাম মাস মাহে রমজান। আলীর মাকাম সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে মাওলানা আবদুর রহমা জামি (রহ.) তার বিখ্যাত শাওয়াহেদুন নবুয়ত গ্রন্থে বলেন, ‘আলীর ফজিলত ও প্রশংসায় এত বেশী হাদিস এসেছে যে, কলম দিয়ে লিখে কিংবা মুখে বলে শেষ করা সম্ভব নয়।’ আলীর (রা.) মর্যাদা সম্পর্কে আল্লামা সাফুরী (রহ.) লেখেন, ‘একবার সিদ্দিকে আকবর (রা.) আলীকে দেখে মুচকি হাসলেন। আলী জানতে চাইলেন, হে আবু বকর! কেনো আমাকে দেখে হাসছেন? আবু বকর (রা.) বললেন, ‘অভিনন্দন গ্রহণ করুন! নবিজি (সা.) আমাকে বলেছেন, আলীর অনুমতি ছাড়া কেউ পুলসিরাত পার হতে পারবে না।’ (নুজহাতুল মাজালিস, ২য় খন্ড, ৩০৬ পৃষ্ঠা। )

মক্কার বীরদের মধ্যে আলী (রা.) ছিলেন শ্রেষ্ঠ। মোজেজায়ে আম্বিয়া গ্রন্থে এসেছে, আলীর বীরত্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে একবার ইমাম হাসান (রা.) বলেন, ‘আমার আব্বা জীবনে কোনো যুদ্ধে পরাজিত হননি। এর রহস্য হল, যখনই নানাজান রাসুল (সা.) আব্বাজানকে কোনো যুদ্ধে পাঠাতেন তখন আব্বাজানের ডানে থাকত ফেরেশতা জিবরাইল এবং বামে থাকত ফেরেশতা মিকাইল (আ.)।’ (শানে আহলে বাইত, ১২২ পৃষ্ঠা। ) আলীর (রা.) মর্তবা সম্পর্কে সাইয়েদ আবুল হাসান আলী দাতাগঞ্জে বখশ হাজবেরি (রহ.) একটি আশ্চর্য ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘হিজরতের রাতে রাসুল (সা.) মাওলা আলীকে নিজের বিছানায় নিজের চাদর জড়িয়ে শুয়ে থাকতে বলেন। আলী (রা.) হাসিমুখে তার এ নির্দেশ মেনে নেন। আলী (রা.) জানতেন, কাফের মুশরিকরা অতর্কিত আক্রমণে মুহাম্মদ (সা.) ভেবে তাকে মেরে ফেলবে। তবুও তিনি রাসুলের নিরাপত্তার জন্য খুশিমনে জীবন দিতে প্রস্তুত হয়ে যান। এ ঘটনা দেখে আসমানে রহমতের দরিয়ায় ঢেউ উঠে। আল্লাহ তায়ালা জিবরাইল ও মিকাইল দুই প্রধান ফেরেশতাকে ডেকে বলেন, আমি তোমাদের মাঝে ভ্রাতৃত্ববন্ধন গড়ে দিলাম। এখন থেকে তোমরা একে অপরের ভাই। তোমরা কি পারবে একজন আরেকজনের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে? জবাবে কেউ কোনো কথা বলল না। আল্লাহ বললেন, আমি আলীকে আমার বন্ধুর সঙ্গে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করেছি।

ভাইয়ের জন্য সে নিজের জীবন বিপন্ন করে হাসিমুখে মৃত্যুকে মেনে নিয়েছে। যাও! তোমরা তাকে নিরাপত্তা দাও। সঙ্গে সঙ্গে দুই ফেরেশতা জমিনে এসে আলীর নিরাপত্তায় পাহারা দিতে থাকেন। ঐতিহাসিকরা বলেন, শেষ রাতে যখন কাফেররা ঘরে ঢুকে চাদর উল্টে দেখে বিছানায় মুহাম্মাদ (সা.) নয় আলী (রা.) শুয়ে আছেন, তখন তারা খুবই আশ্চর্যজনকভাবে তাকে হত্যা না করেই ফিরে যান। (কাশফুল মাহজুব, ১৯৮ পৃষ্ঠা। ) খিলাফতে থাকাকালীন মাহে রমজানের ২১ তারিখে আলী (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। এর আগে ১৯ রমজান কুখ্যাত ইবনে মুলজিমের বিষাক্ত ছুরির আঘাতে আহত হন তিনি। হে আল্লাহ! মুসলিম বিশ্বকে আবার আপনি আলীর জ্ঞান ও বিরত্বের নূরানি ফয়েজ দিয়ে জাগিয়ে দিন। আমিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর, www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর