রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা
কোকেনকাণ্ডে জবানবন্দি

লেনদেন হতো ক্রিপটো কারেন্সিতে

সাখাওয়াত কাওসার

ভয়ংকর মাদক কোকেন বিক্রি স্থানীয় মুদ্রায় হলেও ট্রান্সফার হতো ক্রিপটো কারেন্সিতে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাইজেরিয়ার নাগরিক ইজাহা ইমানুয়েল ওরফে চিদারা তার বাইন্যান্স ওয়ালেটের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে এ কাজটি করে আসছিলেন। তবে কোকেন মাফিয়া জ্যাকব ফ্রাঙ্কি ওরফে ডন ফ্রাঙ্কির নির্দেশে বেশির ভাগ সময় ননসো ইজিমা পিটার ওরফে ওস্কার (৩০) নিয়মিত যোগাযোগ করতেন চিদারার সঙ্গে। নিজের গার্লফ্রেন্ড এবং মায়ের কাছে অর্থ পাঠানোর সময় ডন ফ্রাঙ্কি নিজেই যোগাযোগ করতেন চিদারার সঙ্গে। অন্যদিকে ডন ফ্রাঙ্কির অবর্তমানে তার চাচাতো ভাই ডন উইসলি মাদক ব্যবসাসহ সব কিছু দেখাশোনা করতেন। সম্প্রতি গ্রেফতারকৃতরা আদালতে নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছেন। সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মেহেদী হাসানের আদালতে দেওয়া গ্রেফতার মালাউইর নাগরিক নোমথানডাজো তোয়েরা সোকো (৩৫), তানজানিয়ার নাগরিক মোহাম্মদী আলী মোহাম্মদ, নাইজেরিয়ান ননসো ইজিমা পিটার ওরফে ওস্কার, কেলভিন ইয়েঙ্গি, এনডুলে ইবুকা স্ট্যানলি পোডস্কি, বাংলাদেশি নাগরিক সাইফুল ইসলাম রনি, আসাদুজ্জামান আপেলের জবানবন্দিতে বিষয়টি ফাঁস হয়। একই সঙ্গে কোকেন পাচারের রুটে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহারের বিষয়টিও উঠে এসেছে। ২৪ জানুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা মূল্যের সাড়ে ৮ কেজি কোকেন জব্দ করা হয়। এ সময় মাদক বহনের দায়ে আফ্রিকার দেশ মালাউইর নাগরিক নোমথানডাজো তোয়েরা সোকো গ্রেফতার হন। পরে টানা অভিযানে আরও একাধিক নাইজেরীয় এবং একজন তানজানিয়ান নাগরিককে গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)। আদালতসূত্র বলছেন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চিদারা নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও কোকেন সিন্ডিকেটের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। বিশেষ করে কোকেন চক্রের মূল হোতা জ্যাকব ফ্রাঙ্কি ওরফে ডন ফ্রাঙ্কি এবং পিটার ওরফে ওস্কারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন চিদারা। কোকেন পাচারের সময় তিনি গোপন লেনদেনের জন্য নিজের ক্রিপটো কারেন্সি ওয়ালেট বাইন্যান্স ব্যবহারের বিষয়টি জানিয়েছেন। ওস্কারের জবানবন্দিতেও বিষয়টি উঠে এসেছে। ৯ ফেব্রুয়ারি আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ওস্কার বলেন, বাংলাদেশে নাইজেরিয়ান কমিউনিটির সভাপতি হিসেবে ফ্রাঙ্কির সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। তবে আগে থেকেই তিনি ফ্রাঙ্কির মাদক কানেকশন সম্পর্কে জানতেন। কারণ বিভিন্ন সময় ফ্রাঙ্কি তাকে চিদারার অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিতে পাঠাতেন। এ ছাড়া কোকেন নেটওয়ার্কে জড়িত ছিলেন ফ্রাঙ্কির ঘনিষ্ঠ বন্ধু পডোস্কি ও আত্মীয় ডন উইজলি।

২৪ জানুয়ারি কোকেনসহ বিমানবন্দরে গ্রেফতার হওয়ার ১৭ দিন পর ১১ ফেব্রুয়ারি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন সোকো। জবানবন্দিতে সোকো বলেন, মাদক মাফিয়া ডন ফ্রাঙ্কির সঙ্গে ফেসবুকে তার পরিচয়। কথাবার্তার একপর্যায়ে ফ্রাঙ্কি তাকে একটি যৌথ ব্যবসার প্রস্তাব দেন। সে অনুযায়ী গত বছরের শেষের দিকে জুতার ফ্যাক্টরি পরিদর্শনের কথা বলে একবার তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। বিমান টিকিট থেকে শুরু করে হোটেলে থাকার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সবই জোগাড় করে দেন ফ্রাঙ্কি।

এরপর কাপড় ব্যবসার কথা বলে ২০ জানুয়ারি ফের তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। ২৩ জানুয়ারি তিনি নাইজেরিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা থেকে রওনা হন। এ সময় তার কাছে একটি স্যুটকেস দেন ফ্রাঙ্কি। ইথিওপিয়া এয়ারলাইনসে দোহা হয়ে ২৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তিনি ঢাকায় নামেন। ঢাকার উত্তরার একটি হোটেলে তার নামে কক্ষ বুকিং দেওয়া ছিল। কিন্তু সেখানে যাওয়ার আগেই নারকোটিকসের হাতে গ্রেফতার হন।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোকেন পাচার চক্রে সাইফুল ইসলাম রনি ও আসাদুজ্জামান আপেল নামে দুই বাংলাদেশির সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। তারা ছিলেন মূলত সহযোগীর ভূমিকায়। এদের মধ্যে বারিধারার কেয়ারটেকার আসাদুজ্জামান রাতারাতি ধনী হওয়ার লোভে কোকেন চক্রে জড়িয়ে পড়েন। তিনি বারিধারা পার্ক রোডে যে বাড়ির কেয়ারটেকার ছিলেন সেখানে ভাড়াটিয়া ছিলেন ফ্রাঙ্কি। মূলত ভাড়ার টাকা তুলতে গিয়ে ফ্রাঙ্কির সঙ্গে তার পরিচয়। পরে বাসা পরিবর্তন করলেও ফ্রাঙ্কির সঙ্গে তার যোগাযোগ থেকে যায়। একপর্যায়ে ফ্রাঙ্কি তাকে কাপড় ব্যবসার পার্টনার হওয়ার প্রস্তাব দিলে আসাদুজ্জামান তা লুফে নেন। দ্রুততম সময়ে তিনি ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যাংক হিসাবও খোলেন।

আসাদুজ্জামান জবানবন্দিতে বলেন, ফ্রাঙ্কি বাংলাদেশি-নাইজেরিয়ান কমিউনিটির সভাপতি ছিলেন। এ কারণে নাইজেরীয় অনেকের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। বিশেষ করে নাইজেরিয়ান নাগরিক ওস্কার ও পডোস্কি প্রায়ই ফ্রাঙ্কির বাসায় যাতায়াত করতেন। এ ছাড়া ডন উইজলি নামে এক নিকটাত্মীয় ফ্রাঙ্কির বাসাতেই থাকতেন।

ডিএনসিসূত্র বলছেন, কোকেনের চালান নিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার জন্য সাইফুল ইসলাম রনি নামে এক বাংলাদেশিকে ব্যবহার করেন ফ্রাঙ্কি। রনির কাছ থেকে তিনি গার্মেন্ট ব্যবসার আমন্ত্রণপত্র সংগ্রহ করতেন। এ ছাড়া কোকেন পাচার চক্রের সদস্যদের জন্য হোটেল ভাড়া করে দিতেন রনি।

৯ ফেব্রুয়ারি আদালতে জবানবন্দিতে পডোস্কি বলেন, তিনি মূলত বাংলাদেশে ফুটবল খেলেন। তবে বর্তমানে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ফ্রাঙ্কির বারিধারার বাসায় গেলে তার হাতে কোকেনের চালান তুলে দেওয়া হতো। তিনি ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাস করছেন। এ দেশে তিনি গার্মেন্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

কোকেন পাচারে সবশেষ গ্রেফতার হন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাইজেরিয়ান ছাত্র ইজাহা ইমানুয়েল ওরফে চিদারা। পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই দীর্ঘদিন ঢাকায় বসবাস করা চিদারা শিক্ষার্থী পরিচয়ের আড়ালে মূলত মাদক সিন্ডিকেটে জড়িত ছিলেন। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। গ্রেফতারের সময় শেষবর্ষের ছাত্র ছিলেন।

সর্বশেষ খবর