মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা
আলোচনা সভায় শেখ হাসিনা

আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব নয়

নিজস্ব প্রতিবেদক

আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব নয়

তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ ভবনে গতকাল এক আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা -পিআইডি

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমি আহ্বান করেছিলাম, কোনো ইফতার পার্টি নয়। আমরা সাধারণ মানুষের মধ্যে ইফতার বিতরণ করব। আমাদের নেতা-কর্মীরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আর বিএনপি মানুষকে ইফতার দেয় না, নিজেরা ইফতার পার্টি খায়। ইফতার পার্টিতে গিয়েও আল্লাহ রসুলের নাম না নিয়ে আওয়ামী লীগের গিবত গায়। দেশবাসী পক্ষে রয়েছে, কাজেই সরকারের পতন ঘটানো এবং দেশকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া সম্ভব নয়। গতকাল দুপুরে তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ ভবনে এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। বিরোধীদের প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা খেয়ে-দেয়ে মাইক একটা লাগিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করবেন। আওয়ামী লীগের অপরাধটা কী। এ দেশ স্বাধীন করেছে, সেটা অপরাধ? তিনি বলেন, নির্বাচন ঠেকাবে, ঠেকাতে পারেনি। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে। ওদের ভোটের চেহারার কথা তো আমাদের মনে আছে। আমরা সাধারণ মানুষকে ইফতার বিলি করি। আর তোমরা ইফতার খাও, তোমরা খেতে জানো। তোমরা হচ্ছো খাই খাই। আর আওয়ামী লীগ দেয় দেয়। এটাই হচ্ছে তফাৎ। বিএনপিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, জাতির পিতাকে হত্যার পর নিজেই (জিয়াউর রহমান) নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে ক্ষমতায় বসে। এটা কোনো গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে হয়নি। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের হাত দিয়ে হয়েছে। তারা গণতন্ত্রের ভাষা বোঝে? গণতন্ত্রের অর্থ বোঝে? গণতন্ত্র বানান করতে পারে? সেটাই আমার প্রশ্ন। এ দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্র দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আজকে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আছে বলেই কথা বলতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলে তারা তো দেয় নাই, একটাই টেলিভিশন ছিল, একটাই রেডিও ছিল, তারা নিজেরাই ব্যবহার করত। আর মাত্র কয়েকটা পত্রিকা ছিল। আর আজ হাজার হাজার পত্রিকা। প্রায় অর্ধশত টেলিভিশন, রেডিও আমাদের হয়ে গেছে। যার যার ইচ্ছামতো টকশো করছে, কথা বলে যাচ্ছে। সব কথা বলেও যদি বলে যে, কথা বলতে পারি না, তাহলে কোথায় যাব আমরা। তিনি বলেন, ২০০১ সালের পয়লা অক্টোবরের নির্বাচনের দিন থেকে আওয়ামী লীগের ওপর যে অত্যাচার, যে নির্যাতন করছে, সে কথা মানুষ ভুলবে কী করে। আজকে দেশে মানুষ যদি কিছু পেয়ে থাকে তাহলে আওয়ামী লীগের হাত থেকেই পেয়েছে। স্বাধীনতা পেয়েছে, গণতন্ত্র পেয়েছে, গণতান্ত্রিক অধিকার পেয়েছে, আজকের বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি ডাল-ভাতের ওয়াদা করে ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর একজন এসে আলু খেতে বলল, ভাতের পরিবর্তে আলু। আওয়ামী লীগের আমলে অন্তত ভাতের কষ্ট নাই। এটা আমরা বলতে পারি। এখন জিনিসের দাম নিয়ে মানুষ বলছে, মুরগির দাম বাড়ল কেন, পিঁয়াজের দাম বাড়ল কেন, চিনির দাম বাড়ল কেন, তেলের দাম বাড়ল কেন। একসময় দেশের মানুষ নুন-ভাতের কথা চিন্তা করত। সেটুকু জোগাড় করতে পারত না। এখন সেই অবস্থা থেকে আওয়ামী লীগ পরিবর্তন করতে পেরেছে। তিনি বলেন, আজকে খাদ্যশস্য, দানাদার শস্য আমরা চার গুণ উৎপাদন বৃদ্ধি করেছি। আজকে আমরা ইলিশ মাছের উৎপাদন আড়াই গুণ বৃদ্ধি করেছি। আমাদের গবাদি পশু সেটাও দুই গুণ বৃদ্ধি হয়েছে। মুরগি, পোলট্র্রি চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাত গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে দুধের উৎপাদন। প্রত্যেকটা জিনিসের উৎপাদন আমরা বৃদ্ধি করেছি। মাংসের দাম বেড়ে গেছে, তবে আট গুণ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশে। তিনি বলেন, আজকে ওরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। কোন সাহসে চায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। তখন খালেদা জিয়াও সুস্থ, তারেক জিয়া মুচলেকা দিয়ে লন্ডনে গিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে, এই রমরমা অবস্থায় আসন পেয়েছিল মাত্র ৩০টা। আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৩৩টা। এটা তো মনে রাখা উচিত। তাহলে কীসের আশায় আবার তত্ত্বাবধায়ক চায়। শেখ হাসিনা বলেন, যে আদর্শ, চেতনা নিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছিলেন আমার বাবা, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন, ভাগ্য পরিবর্তন করবেন, জীবনমান উন্নয়ন করবেন, সেই আকাক্সক্ষা, আদর্শ তো ব্যর্থ হতে পারে না। সেজন্য সব কষ্ট, শোক বুকে নিয়েও আজ মানুষের পাশে আছি, মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করার জন্য। বঙ্গবন্ধুর বারবার গ্রেফতার হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ দেশের ভাষা আন্দোলন তিনি শুরু করেন।

বায়ান্ন সালে মুক্তি পাওয়ার পর একটা শান্তি সম্মেলন হয়েছিল চীনে। তিনি চীনে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানের একটা প্রতিনিধি দলের পূর্ববঙ্গের কমিটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও ছিলেন। তখন কতই বা বয়স। কিন্তু একটি দেশে গিয়ে সেই সদ্য স্বাধীন দেশে মানুষের জীবনমান, কৃষকের অবস্থা, শ্রমিকের অবস্থা, নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিটি জিনিস সূক্ষ্মভাবে তিনি দেখেছিলেন। তার লেখা ‘আমার দেখা নয়া চীন’ বইটির মধ্যে সেই সময়কার মানুষের অবস্থা এবং সবচেয়ে লক্ষণীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে একটা দেশে গিয়ে পরিবর্তনটা গভীরভাবে উপলব্ধি করা, দেখা এবং তা লেখা। সেখান থেকে তার মেধার এবং দেশপ্রেমের নমুনা পাওয়া যায়। এ বইগুলো পড়লে জাতির পিতাকে জানতে পারবেন। ১৯৪৮ সাল থেকে করা বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনকে অনেক বিকৃত করা হয়েছে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এমনকি ভাষা আন্দোলনে জাতির পিতার যে ভূমিকা ছিল, তা মুছে ফেলা হয়েছিল। অনেক জ্ঞানী-গুণীরা যেন ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে ওখান থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতা অর্জনের পরও আমরা দেখেছি, ’৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার পর স্বাধীনতার ইতিহাস থেকেও তাঁর নাম মুছে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে ভাষা আন্দোলন থেকে বাঙালি জাতির অভ্যুত্থানের ইতিহাস সবই দেওয়া আছে। রাজনীতি করতে হলে, জাতির পিতার আদর্শের সৈনিক হতে হলে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হলে, বঙ্গবন্ধুর ওপর সেই রিপোর্ট এবং তাঁর লেখা বইগুলো প্রতিটি নেতা-কর্মীর পড়া উচিত। তিনি বলেন, অত্যন্ত সাদাসিধা জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে তিনি ছয় দফা, ৭ মার্চের ভাষণ, পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে ওখান থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পাকিস্তানিরা তারপরই তাঁকে গ্রেফতার করে, বাড়িতে লুটপাট করে, ভাঙচুর করে। ফিরে এসে আবার তিনি সেই বাড়িতেই উঠেছিলেন, মেরামত করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি অন্য কোথাও থাকেননি। ওই ছোট বাড়িটাতেই সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন তিনি। একটা বিশ্বাস সব সময় ছিল যে, বাঙালিরা তাঁকে কখনো মারবে না। আন্তর্জাতিকভাবে অনেকেই বলেছেন, সাবধান করেছেন। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেননি। বলেছেন, ওরা তো আমার ছেলের মতো, আমাকে কেন মারবে। বাঙালি জাতিকে এত গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন যে, তাদের ভিতরে কোনো রকমের কুপ্রবৃত্তি থাকতে পারে, এটাই তিনি ভাবতে পারেননি। এ দেশের কোনো মানুষ তাঁর গায়ে হাত দেবে, হত্যা করবে তা ভাবতে পারেননি। কিন্তু ১৫ আগস্ট আমরা কী দেখলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যারা আমাদের বাড়িতে প্রতিনিয়ত এসেছে, যারা আমার মায়ের হাতের খাবার খেয়ে গেছে, ঘাতক হিসেবে তারা চলে আসল। তারা বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, পরিবারের ওপর আক্রমণ চালাল একসঙ্গে এবং হত্যা করল। ১৫ আগস্ট যারা শাহাদাতবরণ করেছেন, তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। এই হত্যাকাণ্ডের একটা উদ্দেশ্য ছিল, বঙ্গবন্ধুর নামটা মুছে ফেলবে, আর ওই রক্তের কেউ আসতে পারবে না ক্ষমতায় বা আওয়ামী লীগ কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না।

দেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বাবা-মা-ভাই সবাইকে হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলাম। পেয়েছি আমি এ দেশের মানুষের ভালোবাসা। গ্রামে যখন ঘুরেছি, কত মানুষ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে, কাছে টেনে নিয়েছে, পাশে বসিয়েছে। মানুষের সেই ভালোবাসার কথা তো ভোলা যায় না। স্বার্থপর মানুষ অনেক আছে। আশপাশে বেশি থাকবে, বেশি তাদের চাহিদা। কিন্তু গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষ, তাদের চাহিদা খুব কম।

বারবার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করায় দেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ কথা মনে রাখতে হবে, ক্ষমতা ভোগের বস্তু নয় রাজনৈতিক নেতার কাছে। ক্ষমতা জনগণের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য পালন করা।

আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য মোশাররফ হোসেন, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, ডা. দীপু মনি, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মেরিনা জাহান কবিতা, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী। বঙ্গবন্ধুর ওপর কবিতা আবৃত্তি করেন রূপা চক্রবর্তী।

সর্বশেষ খবর