শুক্রবার, ২২ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

কোঁচড় ভরে নেকি কুড়ানোর মাস

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

কোঁচড় ভরে নেকি কুড়ানোর মাস

শীতের সকালে কোঁচড় ভরে শিউলি ফুল তোলার কথা কি মনে পড়ে! কী মিষ্টি সে স্মৃতি! বৃষ্টিভেজা কোনো বিকালে যখন অকারণেই মন খারাপ হয়ে যায়, চোখের পাতায় ভেসে ওঠে ছেলেবেলার ফুল কুড়ানো সকালের কথা। সঙ্গীদের আগেই বলে রাখতাম সাহরি খেয়ে ঘুমানো চলবে না। চারদিক ফর্সা হলে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তাম। বাড়ির কেউ যেন টের না পায় তাই বেড়ালের মতো পা টিপে টিপে রাস্তায় নামতেই দেখতাম আরও দু-একজন অপেক্ষা করছে আমার জন্য। দেরি হয়েছে বলে লজ্জায় লাল হয়ে ফিস ফিস করে বলতাম, মা এখনো জেগে আছে, অনেক কষ্টে ফাঁকি দিয়েছি। সকালের হিমেল হাওয়ায় হাঁটি হাঁটি পায়ে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এক বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। খুব সাবধানে দেয়াল টপকে শুরু হতো নিঃশব্দে ফুল তোলা। ফুলে ফুলে যখন কোঁচড় ভরে যেত তখন চারদিকে বেশ ভালোই আলো ছড়িয়ে পড়েছে। ততক্ষণে বাড়িঅলা কাকা এসে মেইন গেট খুলে দিত। কোঁচড় ভর্তি ফুল এনে ঢেলে দিতাম মায়ের কোলে।

ছেলেবেলার কোঁচড় ভরে ফুল কুড়ানোর সঙ্গে বড়বেলার রমজানের একটা সুন্দর উপমা আল্লাহ হৃদয়ে ঢেলে দিলেন। আমরা যদি শিশুর মতো নির্মল মন নিয়ে কোঁচড় ভর্তি নেকি কুড়ানোর মাস হিসেবে রমজানকে কাজে লাগাতে পারি, আশা করা যায় কবরের জীবনে প্রতিটি রোজা নূরের ফুল ছিটিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানাবে। তাছাড়া হাদিসে তো বলাই আছে, মানুষকে কবরে রাখার সঙ্গে সঙ্গে তার পায়ের কাছে কিংবা ডান দিকে রোজা এসে কবরের আজাব প্রতিরোধ করবে।

প্রিয় পাঠক! কোঁচড় ভরে নেকি কুড়ানোর জন্য রমজানজুড়ে দুহাত ভরে দান করতে হবে। নিজের কষ্টার্জিত সম্পদ মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যেই আল্লাহর প্রিয় হওয়ার সুযোগ রয়েছে। যতটুকু মনে পড়ছে হাদিসখানা বুখারি শরিফের, জলিলে কদর সাহাবি হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমাদের মধ্যে রসুল (সা.) ছিলেন সবচেয়ে বেশি দানশীল। কখনো কোনো প্রার্থীকে তিনি খালি হাতে ফেরাতেন না। বছরজুড়েই অত্যধিক দান-খয়রাত করতেন। তবে রমজানের দৃশ্য ছিল ভিন্ন। এ সময় তিনি জোয়ারের পানির মতো দান করতেন। তার দানের পরিমাণ গুণে শেষ করা যেত না। কি সকাল! কি বিকাল! সন্ধ্যা কিংবা রাত সবসময় তিনি দান করতেন। এ সময় হজরত জিবরাইল (আ.) তাঁর কাছে কোরআন শুনতেন এবং শোনাতেন।’ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দাতা কে? এ প্রশ্নের জবাব হুজুর (সা.) নিজে দিয়েছেন সাহাবিদের। হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘রসুল (সা.) একবার আমাদের প্রশ্ন করলেন- তোমরা কি জানো সব দাতার চেয়ে বড় দাতা কে? তিনি হলেন আল্লাহতায়ালা। আর আদম সন্তানের মধ্যে আমি শ্রেষ্ঠ দাতা। আমার পর শ্রেষ্ঠ দাতা হলো শিক্ষক সমাজ।’ রমজানে রসুলের দানের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার একটি সম্ভাব্য কারণ বলেছেন বিখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা ইবনে রজব (রহ.)। তিনি বলেন, ‘রমজানে আল্লাহতায়ালা বান্দার ওপর আসমানের দুয়ার খুলে দেন। বান্দার ওপর অঝোরে রহমত বর্ষণ করতে থাকেন। ছোট্ট নেক আমলকে বড় নেক আমল হিসেবে গুণে রাখেন। তাই নবীজিও উম্মতের প্রতি দানের হাত খুলে দেন। জোয়ারের পানির মতো বেহিসাব দান করতে থাকেন।’ কেবল অর্থ ব্যয় দান নয়- সময়, শ্রম, মেধা ও জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করাই হলো পরিপূর্ণ দান। রসুল (সা.) সব দিক থেকেই পৃথিবীর সেরা দানবীর ছিলেন। ইবনে রজব (রহ.) বলেন, নবুওয়তের পরে তো বটেই এমনকি নবুওয়তের আগেও রসুল ছিলেন সব দাতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ দাতা। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বুখারি শরিফের কিতাবুল ওহির হাদিসে। রসুল (সা.) যখন ওহি পেয়ে ভয়ে মা খাদিজার কোলে ছুটে এলেন, মা খাদিজা (রা.) তখন এক ঐতিহাসিক স্বীকৃত দিয়ে হজরতকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি ভয় পাবেন না। আল্লাহর কসম! আপনার ওপর কোনো খারাপ জিন আছর করতে পারে না। আপনি তো আত্মীয়তা রক্ষা করেন, মেহমানের আপ্যায়ন করেন, মানুষের বোঝা বহন করেন, দুস্থের জীবিকার ব্যবস্থা করেন এবং বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ান।’

প্রিয় পাঠক! মাহে রমজানের পরিপূর্ণ ফায়দা অর্জন করতে হলে আসুন আমরা হাত খুলে দান করি। মন খুলে মানুষের পাশে দাঁড়াই। কথা-আচরণে আরও শালীন ও ভদ্র হই। আপন-পর সবাইকে ভালো পরামর্শ দিই। হিংসা ভুলে মন খুলে সবার সুস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধির দোয়া করি। আল্লাহ আমাদের জীবন সুখ-শান্তি দিয়ে ভরে দিন। আমিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর, www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর