সোমবার, ২৫ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

তারাবির ইতিহাসে আছে ঐক্যের সবক

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

তারাবির ইতিহাসে আছে ঐক্যের সবক

আবির্ভাবের পর থেকেই ইসলাম ঐক্যের মন্ত্রে দীক্ষিত করেছে মুসলমানদের। ঐক্যের শক্তিতেই মুসলমানরা বিশ্ব জয় করেছে। আবার মুসলমানরা যখন ঐক্যহারা হয়ে আল্লাহর রহমতহারা হয়েছে, তখন থেকেই তাদের জীবনে নেমে এসেছে পরাজয়ের গ্লানি। নামাজ-রোজা-হজ-জাকাত-জিহাদসহ প্রতিটি ইবাদতেই ইসলাম দিয়েছে ঐক্যের তাগিদ। মাহে রমজানের তারাবির ইতিহাসেও লুকিয়ে আছে মুসলমানদের জন্য ঐক্যের সবক। শুরুতে মুসলমানরা একাকী তারাবি পড়ত। খলিফা ওমর (রা.) মুসলমানদের এক ইমামের পেছনে তারাবিতে কাতারবন্দি করে দেন। নির্ভরযোগ্য হাদিস ও ইতিহাসের গ্রন্থাবলি ঘেঁটে পাওয়া তথ্য থেকে জানাচ্ছি তারাবির ইতিহাস।

জামায়াতের সঙ্গে সালাতুত তারাবিহের বর্তমান নিয়মটি চালু হয়েছে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুকের (রা.) সময় থেকে। এর আগে অর্থাৎ রসুলেপাক (সা.) ও সিদ্দিকে আকবরের (রা.) সময়ে এমনকি ফারুকে আজমের খেলাফতের প্রথমদিকেও মুসলমানরা তারাবির নামাজ একাকী বা গুচ্ছ জামাতে পড়তেন। তবে নবীকরিম (সা.) রমজানে কিয়ামুল লাইল বা রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগির বিশেষ উৎসাহ দিয়েছেন এবং এ জন্য অশেষ পুরস্কারের সুসংবাদ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণিত একটি হাদিস উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন, ‘রসুল (সা.) রমজানের রাতগুলোতে ইবাদত করার জন্য আমাদের উৎসাহ দিতেন। কিন্তু জোরালো আদেশ দিতেন না। তিনি বলতেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে বিশ্বাস ও আত্মসচেতন হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে থাকবে, তার জীবনের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ এভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাতের ইবাদত করার নিয়ম চালু ছিল তার জীবদ্দশায়। হজরত আবু বকরের (রা.) সময়ে একই নিয়ম চালু ছিল। এটি বহাল ছিল হজরত ওমর ফারুকের (রা.) খেলাফতকালের প্রথম ভাগেও।’ (বুখারি শরিফ)। হজরত ওমর ফারুকের সময়ে জামাতের সঙ্গে সালাতুত তারাবিহ চালু হওয়া সম্পর্কে একটি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন আবদুর রহমান ইবনে সায়েব ইবনে আবদুল কারি নামে এক তাবেয়ি। তিনি বলেন, ‘রমজানের এক রাতে হজরত ওমর ফারুকের (রা.) সঙ্গে আমি মসজিদে নববীতে গেলাম। দেখলাম লোকেরা বিক্ষিপ্তভাবে ইবাদত করছে। কেউ একাকী, আবার কারও সঙ্গে কয়েকজন যোগ দিয়ে নফল নামাজ আদায় করছেন। হজরত ওমর (রা.) বললেন, এদের সবাইকে একজন ইমামের পেছনে একত্র করে দিলে ভালো হতো। পরে হজরত উবাই ইবনে কাবকে ইমাম নিযুক্ত করা হয়। হজরত উবাই (রা.) ছিলেন সাহাবিদের মধ্যে সবচেয়ে শুদ্ধ ও মধুর কণ্ঠে কোরআন মাজিদ তেলাওয়াতকারী। এরপর একদিন আবারও বের হলেন হজরত ওমর (রা.)। বর্ণনাকারী আবদুর রহমান বলেন, হজরত উবাইয়ের (রা.) ইমামতিতে তখন এ নামাজ চলছে। পরিবেশটি দেখে হজরত ওমর মুগ্ধ হলেন এবং বললেন, চমৎকার আবিষ্কার এটি। তবে তিনি একই সঙ্গে একটি মন্তব্যও করলেন। বললেন, তোমাদের ঘুমের সময়টা তোমাদের জেগে থাকার সময় থেকে ভালো। অর্থাৎ হজরত ওমরের ব্যক্তিগত পছন্দ ছিল লোকেরা প্রথম রাতে এশার নামাজের পরই ঘুমিয়ে পড়ুক আর মধ্য রাতের পর ইবাদতে মশগুল হোক। কিন্তু তা সাধারণভাবে কষ্টের কাজ। লোকেরা এমনটি অভ্যাস করতে পারবে বলে তিনি মনে করলেন না। তা ছাড়া একাকী দীর্ঘক্ষণ সালাত আদায় করার চেয়ে জামাতের সঙ্গে আদায় করা কম কষ্টকর। তেমনি কোরআন মাজিদের বড় বড় সুরা সবার মুখস্থ থাকে না। এসব দিক বিবেচনা করে সবার জন্য যা সহজ হয় তারই ব্যবস্থা করলেন ওমর (রা.)।

তারাবির নামাজকে তারাবি নাম দেওয়ার পেছনেও আছে মজার ব্যাখ্যা। বিশ্লেষকরা বলেন, তারাবি নামে আখ্যায়িত হওয়ার কারণ মাঝখানের বিরতিগুলো। ২০ রাকাত নামাজ আদায় করতে গিয়ে প্রতি চার রাকাতের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার রীতি তখন থেকেই ছিল। কেননা এ সালাত আদায় করা হয় দীর্ঘ সময় ধরে। আরবি ‘তারবিহা’ অর্থ বিশ্রাম। আর তারবিহা শব্দের বহুবচন তারাবিহ। হায়! যে তারাবির সবক ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকা, সেই তারাবি নিয়েই আমাদের ঝগড়া। আল্লাহ আমাদের সব ঝগড়া ভুলে এক হয়ে নেক জীবনযাপনের তৌফিক দিন। আমিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর