মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা
স্বাধীনতার ৫৩ বছর

সমৃদ্ধির সঙ্গে বেড়েছে বৈষম্য

জুলকার নাইন ও মানিক মুনতাসির

সমৃদ্ধির সঙ্গে বেড়েছে বৈষম্য

সম্বলহীন যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে শক্ত ভিত্তি করে উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় দ্রুত এগোচ্ছে। কিন্তু যে বৈষম্যের কারণে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন, সেই ধনী-গরিব ও উঁচুনিচুর বৈষম্য দিন দিন প্রকট হচ্ছে বলে মনে করে অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্বাধীনতার পর যেখানে শুধু ভাত ও রুটির ওপর নির্ভরশীল ছিল বাংলাদেশ। পাঁচ দশকের ব্যবধানে সেখানে  মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, সবজি ও ফলমূল উৎপাদনেও রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। সবমিলিয়ে খাদ্যে অর্জন করেছে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। যার ফলে দেশ একটু একটু করে পৌঁছে গেছে সমৃদ্ধির সোপানে। একই সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, স্যানিটেশনসহ আরও অনেক সূচকে ৫৩ বছর বয়সে বহুদূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। শুধু অভ্যন্তরেই নয়, বিশ্ব পরিমণ্ডলেও সুনাম কুড়াচ্ছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিশ্ববাজারে আজ দারুণভাবে সমাদৃত। ১ কোটির বেশি বাংলাদেশি অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ৯ বিলিয়ন থেকে মাত্র দেড় দশকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উঠেছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারে। এক সময়ের ভুখা, দরিদ্র বাংলাদেশ এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। তবে এর সঙ্গে নানা রকম অদক্ষতা, অনিয়ম-দুর্নীতি ও সম্পদের সুষম বণ্টনের অভাবে বেড়েছে ধরী-গরিবের বৈষম্য। গত এক দশকে এ বৈষম্য প্রকট থেকে আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। ধনীরাই দিন দিন ধনী হচ্ছেন। আর গরিবরা হচ্ছে অতি গরিব। যা দেশের সমাজ ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে তৈরি করেছে এক ধরনের অস্বস্তি আর অসমতা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে শেষ অর্থবছরে (২০২২-২৩) দেশে মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬০ টাকা, যা আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) ছিল ২ লাখ ৪১ হাজার ৪৭ টাকা। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও গড়ে বেশি আয় করেন। মাথাপিছু এ আয়ের ক্ষেত্রে কয়েক বছর ধরেই ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। অথচ দুই দশক আগেও ভারত ও পাকিস্তান বেশ এগিয়ে ছিল বাংলাদেশের চেয়ে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরের মধ্যেই মাথাপিছু জিডিপিতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় শক্তির দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অনন্য মডেল বাংলাদেশ : হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন-এইচএসবিসির সর্বশেষ গ্লোবাল রিসার্চে বলা হয়েছে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) নিরিখে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৪২তম। ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ২০৩০ : আওয়ার লং-টার্ম প্রজেকশনস ফর ৭৫ কান্ট্রিজ’ শিরোনামের এ রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ১৬ ধাপে উন্নীত হবে। যা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় অধিক। অর্থনৈতিক উন্নয়নের এ তালিকায় বাংলাদেশের পরেই ফিলিপাইন, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার নাম এসেছে। প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিক থেকে উন্নত দেশ নরওয়ের চেয়েও বাংলাদেশের অধিক সম্ভাবনা রয়েছে বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এইচএসবিসির দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন মডেলে দেখানো হয়েছে, ২০৩০ পর্যন্ত প্রতিবছর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গড়ে ৭ দশমিক ১ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে, যা রিপোর্টে উল্লিখিত ৭৫টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০২৩ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে ৭ শতাংশ এবং ২০২৮ থেকে ২০৩৩ সালের মধ্যে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে পূর্বাভাবস দেওয়া হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বর্তমান বাংলাদেশের ৩০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ২০৩০ সালে পৌঁছে যাবে ৭০০ বিলিয়ন ডলারে। জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ক্রয়ক্ষমতার বিবেচনায় ৩৩তম। আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় অবস্থানে।

অন্যদিকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্য আয়ের দেশ। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে করোনার এই মহামারিকালেই। বিশ্বের বহু দেশ যখন করোনা মোকাবিলায় হিমশিম খেয়েছে, স্থবির হয়ে পড়েছে অর্থনীতি, বাংলাদেশ সেখানে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের বহু উন্নত দেশকে পেছনে ফেলে অনেকের আগে করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

বেড়েছে ধনী-গরিবের বৈষম্য : অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জিত হলেও স্বাধীনতার অন্যতম মূল লক্ষ্য বৈষম্য নিরসন করা সম্ভব হয়নি। বরং দিনে দিনে এ বৈষম্য বেড়েছে অনেক গুণ। ব্যাংক খাতের আমানতের অর্ধেকেরই মালিক দেশের কোটিপতিরা। অর্থাৎ ধনীরাই ধনী হচ্ছেন। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল পাঁচজন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতিদের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এভাবে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে কোটিপতি অ্যাকাউন্ট দাঁড়ায় ১ লাখ ১ হাজার ৯৭৬টিতে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৬টি। দেশের ব্যাংকগুলোতে মোট অ্যাকাউন্টের সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি ৫০ লাখ। এসব অ্যাকাউন্টে যে পরিমাণ অর্থ জমা আছে, তার অর্ধেকের মালিক ১ লাখ ১৬ হাজার ৯০৮ জন অ্যাকাউন্টধারী। সে হিসাবে ব্যাংকখাতের মোট আমানতের প্রায় অর্ধেকের মালিকই কোটিপতিরাই। এদিকে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে আয়বৈষম্য আরও বেড়েছে। ধনীদের আয় আরও বেড়েছে। যেমন দেশের সবচেয়ে বেশি ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতেই এখন দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত ৫২ বছরে ধনীদের আয় অনেক বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে ধনী ও গরিবের আয়বৈষম্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর চূড়ান্ত ফলাফলে এ চিত্র উঠে এসেছে। গত এক যুগে দেশে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি যেমন বেড়েছে, সঙ্গে দ্রুতগতিতে বৈষম্যও বেড়েছে। বৈষম্যের নির্দেশক গিনি সহগ সূচক এখন দশমিক ৪৯৯ পয়েন্ট। দশমিক ৫০০ পয়েন্ট পেরোলেই উচ্চ বৈষম্যের দেশ হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ উচ্চ বৈষম্যের দেশ থেকে অতি সামান্য দূরত্বে আছে বাংলাদেশ। দেশে একজন গরিবের তুলনায় একজন ধনীর আয় অন্তত ১১৯ গুণ বেশি। অর্থাৎ একজন গরিব ১ টাকা আয় করলে একজন ধনী আয় করেন ১১৯ টাকা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের আয় বেড়েছে। মোট সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বেড়েছে। তবে ধনী-গরিবের বৈষম্য অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্বস্তি ও অসমতার সৃষ্টি করেছে বলে তিনি মনে করেন।

সর্বশেষ খবর