মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

জাকাতে গতিশীল হয় অর্থনীতির চাকা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

জাকাতে গতিশীল হয় অর্থনীতির চাকা

জাকাত শব্দের ভিতর দুটি অর্থ পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে, অনবরত বাড়তে থাকা। আরেকটি হচ্ছে শুদ্ধ ও পবিত্র হওয়া। আরবি ভাষা বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে জিনিস ক্রমশ বাড়তে  থাকে সে জিনিস অবশ্যই শুদ্ধ ও পবিত্র হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। যেমন আরবিতে বলা হয়, ‘জাকাজ জারউ ইয়াজকুজ জাকাহ। অর্থাৎ, কৃষির ফসল বেড়েছে, যেমনি করে প্রতি বছর বাড়তে থাকে।’ কৃষির ফসল ক্রমশ বাড়তে থাকবে তখনই যখন ফসল আবর্জনা মুক্ত পরিচ্ছন্ন হয়। তাই জাকাত শব্দটির অর্থ ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি পবিত্র ও খাঁটি হওয়া। মন্দ কিছু যদি ক্রমশ বাড়তে থাকে তাহলে সে ক্ষেত্রে জাকাত শব্দের প্রয়োগ সঠিক হবে না। যেমন আরবি রিবা শব্দের অর্থও বৃদ্ধি পাওয়া। কিন্তু এই বৃদ্ধির সঙ্গে পবিত্রতার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই সুদের প্রতিশব্দ হিসেবে ‘রিবা’ ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লামা ইউসুফ কারজাভি (রহ.) তার বিখ্যাত ফিকহুজ জাকাত গ্রন্থে লিখেছেন, জাকাত শব্দটি যদি মানুষের গুণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় তাহলে অর্থ হবে সুস্থতা-সুসংবদ্ধতা। যেমন বলা হয়, ‘রজলুজ জাকা। অর্থাৎ, পবিত্র জাতির মধ্যে চরম মাত্রার কল্যাণকর ব্যক্তি।’ আবার বলা হয়, ‘জাকাল কাজিস শাহুদ। অর্থাৎ, সাক্ষ্য-প্রমাণে অধিকতর কল্যাণকর বিচারক।’ জাকাতের এত অর্থ থাকা সত্ত্বেও শরিয়তের দৃষ্টিতে শব্দটি ধন-সম্পদে আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট ফরজ অংশ বোঝানোর জন্য ব্যবহার হয়েছে।। আর হকদারদের সে সম্পদ দেওয়ার প্রক্রিয়াকে জাকাত বলা হয়। ইমান নববী (রহ.) বলেন, ‘ধন-সম্পদ থেকে আল্লাহর নির্ধারিত সম্পদ বের করে দেওয়া জাকাত বলার কারণ হলো-এর বিনিময়ে সম্পদ ক্রমশ বাড়তে থাকে আর জাকাত দাতা অনেক বিপদ আপদ থেকে পবিত্র থাকে।’ সুফিয়ানেকেরাম বলেন, জাকাত মানুষকে দুই ধরনের বিপদ থেকে সুরক্ষা দেয়। প্রথমত, আখেরাতের জবাবদিহি থেকে। দ্বিতীয়ত, দুনিয়ার বালা মুসিবত থেকে। এ কারণেই জাকাতের দ্বিতীয় অর্থ হলো পবিত্রতা বা শুদ্ধতা। অন্য একজন ইসলামিক স্কলার লিখেছেন, ‘জাকাতের মাধ্যমে ব্যক্তি দুই ধরনের পবিত্রতা অর্জন করে। প্রথমত, সে তার সম্পদ পবিত্র করে। দ্বিতীয়ত, তার মন-মনন কৃপণতা, স্বার্থপরতা, হিংসা বিদ্বেষ মুক্ত হয়ে যায়।’ বিষয়টি ইমাম ইবনে তাইমিয়া আরও চমৎকার করে বলেছেন- ‘জাকাত দেওয়ার ফলে দাতার মন আত্মা নির্মল-পবিত্র হওয়ার কারণে তার ধন-সম্পদে আল্লাহ বরকত দেন এবং তা দিন দিন বাড়তে থাকে।’ কারজাভি বলেন, ‘এই বৃদ্ধি কেবল ধন সম্পদে নয়, ব্যক্তির মন-মানসিকতা, ধ্যান-ধারণায় প্রভাবিত হয়। ফলে জাকাত দাতা দিন দিন উন্নত রুচিরোধ সম্পন্ন মানুষ হয়ে ওঠেন।’ ইমাম নববী ‘আল-হাভী গ্রন্থ প্রণেতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘আরবি জাকাত শব্দটি ইসলামী শরিয়ত প্রবর্তনের আগেও বেশ পরিচিত ছিল। জাহেলি যুগের কাব্য ও কবিতায় এর ব্যবহার পাওয়া যায়। তবে ইমাম দাউদ জাহেরি এই মতটি নাকচ করে বলেছেন, ‘ইসলামের আগে জাকাত শব্দের প্রচলন পাওয়া যায়নি।’ (ফিকহুজ জাকাত।) জাকাতের মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্রের ভিতর অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় থাকে। ইসলামে সম্পদ বণ্টনব্যবস্থায় ধনীরা তাদের সম্পদের কিছু অংশ জাকাত দিলে গরিবদের সম্পদ কিছুটা বেড়ে যায় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হয়। জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামলে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দারিদ্র্য বিমোচন করে মুসলিম উম্মাহকে সমকালীন বিশ্বে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতিতে পরিণত করেছিল।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর, www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর