ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা গত তিন মাসে পাচার হয়েছে। এসব টাকা পাচার হয়েছে দুবাইয়ে বসে নিয়ন্ত্রণ করা একটি অ্যাপসে। এ অভিযোগে পাঁচ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। বুধবার রাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গতকাল রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব জানান সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন- নাসিম আহেমেদ, ফজলে রাব্বি সুমন, কামরুজ্জামান, জহির উদ্দিন ও খায়রুল ইসলাম পিয়াস। তাদের কাছ থেকে ছয়টি মোবাইলফোন, ১৮টি সিম কার্ড, একটি ল্যাপটপ, ছয়টি মডেম ও নগদ ২৮ লাখ ৫১ হাজার টাকা জব্দ করা হয়েছে।
সিআইডি প্রধান বলেন, গ্রেফতার হওয়া এই ব্যক্তিরা ‘জেট রোবটিক অ্যাপস’-এর মাধ্যমে অভিনব কৌশলে ৪০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। তারা চট্টগ্রামের তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটস নামে একটি বিকাশ ডিস্ট্রিবিউশন হাউসের কাছ থেকে এজেন্ট সিম সংগ্রহ করে। সিমগুলো মডেমের মাধ্যমে ল্যাপটপে ও কম্পিউটারে সংযুক্ত করে। জেট রোবটিক অ্যাপসের মাধ্যমে সংযুক্ত সিমের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অ্যাপস নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তিদের হাতে। তারা ?সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই অফিস থেকে ডিজিটাল হুন্ডির কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এই ডিজিটাল হুন্ডি চক্রটির হোতা শহিদুল ইসলাম মামুন। তিনি ২০২০ সাল থেকে দুবাই অবস্থান করছেন। সেখানে মামুনসহ পাঁচজন জেট রোবটিক অ্যাপসের নিয়ন্ত্রক। তারা মালয়েশিয়ান একজন সফটওয়্যার ডেভেলপারের মাধ্যমে তৈরি করা অ্যাপসটিকে কাস্টমাইজ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। এজেন্ট সিমগুলো বাংলাদেশে থাকলেও মূলত সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে দুবাই থেকে। দুবাই থেকে তারা বাংলাদেশের নগদ, বিকাশসহ বিভিন্ন এমএফএস সার্ভিসে ক্যাশ-ইন এর মাধ্যমে টাকা পাঠাতে পারে। এই হুন্ডির কাজে তারা বিশ্বস্ত এজেন্টের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে। সংগ্রহ করা টাকা কোন নম্বরে বা কোন ব্যাংক হিসাবে পাঠাতে হবে সেটা নিশ্চিত হয়। তখন বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করা এজেন্ট সিম থেকে অ্যাপস ব্যবহার করে প্রবাসীদের আত্মীয়দের নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দেয়।অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, এই চক্র চট্টগ্রামের চাঁদগাঁও অবস্থিত তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটস থেকে ১৫০টি এজেন্ট সিম সংগ্রহ করে ব্যবহার করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মাত্র তিন মাসে চক্রটি প্রায় ৪০০ কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছে। আর এসব টাকা পাচারে ১ হাজার ১০০ সিম ব্যবহার করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
সিআইডি বলছে, এই চক্রের কারণে বিদেশ থেকে দেশে রেমিট্যান্স আসায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। অনেকের অবৈধ উপার্জনের টাকা এই চক্রের মাধ্যমে বৈধ হচ্ছে। চক্রটি দুই ভাগে হুন্ডির কাজ পরিচালনা করেন। দুবাইয়ে থাকা চক্রের সদস্য প্রবাসীদের কাছ থেকে বিদেশি মুদ্রা সংগ্রহ করেন। আর দেশে থাকা চক্রের সদস্যরা ওই প্রবাসীর দেওয়া এমএফএস অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেন। এতে প্রবাসীদের মাধ্যমে যে রেমিট্যান্স আসত সেটা ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের কালো টাকার মালিকরা এই চক্রের মাধ্যমে তাদের অবৈধ উপার্জন বৈধ করছেন। আর এই পুরো কাজটি পরিচালিত হতো জেট রোবটিকস অ্যাপসের মাধ্যমে। চক্রের সঙ্গে এমএফএস কোম্পানির চট্টগ্রামের তাসনিমা অ্যাসোসিয়েট নামের একটি ডিস্ট্রিবিউশন হাউসের লোকজন জড়িত। তাদের কাছ থেকে কম লেনদেন হয় এমন এমএফএস এজেন্ট অ্যাকাউন্ট সংগ্রহ করতেন চক্রের সদস্যরা। বিনিময়ে ডিস্ট্রিবিউশন হাউসের লোকজন হুন্ডির লাভের টাকার একটি ভাগ পেতেন। সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী বলেন, একটি ডিস্ট্রিবিউশন হাউসের অধীনে প্রায় ১ হাজার ১০০-এর মতো এজেন্ট থাকে। যেসব এজেন্ট অ্যাকাউন্টে লেনদেন কম হয়, সেই সব অ্যাকাউন্ট হুন্ডির কাজে ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে এমএফএস কোম্পানির নজরদারির ঘাটতি রয়েছে। গ্রেফতার পাঁচজনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা হবে। এর সঙ্গে যদি এমএফএস কোম্পানির কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।