শিরোনাম
রবিবার, ৩১ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

বুয়েটে শিক্ষার্থীদের আলটিমেটাম

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক

বুয়েটে শিক্ষার্থীদের আলটিমেটাম

ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রবেশ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর প্রতিবাদসহ ৬ দফা দাবিতে গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল ৭টা থেকে শুরু করে বিক্ষোভ চলে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। তারা দাবি আদায়ে আলটিমেটাম দেন।

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত একদল শিক্ষার্থী ক্রমাগত বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করেছেন। চলমান ঘটনাপ্রবাহের বিরুদ্ধে আজ সকালে শহীদ মিনার চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিয়েছে ছাত্রলীগ। গত বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) দিবাগত রাত ১টার দিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি, দফতর সম্পাদকসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা তাদের রাজনৈতিক কর্মীবহর নিয়ে মূল গেট দিয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। এ ঘটনায় গত শুক্রবার থেকে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো আন্দোলন শেষ করে আবার আজ থেকে তৃতীয় দিনের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। দাবি আদায়ে গতকাল ও আজকের (৩০ ও ৩১ মার্চ) পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা গতকালের টার্ম পরীক্ষায় অংশ নেননি। শিক্ষকরা পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে আবার ফেরত যেতে বাধ্য হন।

লিখিত বক্তব্যে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আমাদের আন্দোলনের পর তথাকথিত রাজনৈতিক সংগঠনের কিছু ব্যক্তিকে ফেসবুকে পোস্ট করে আমাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে অপপ্রচার চালাতে দেখি। আমরা তাদের এমন বক্তব্যের ধিক্কার জানাই। আমরা সব সময়ই বুয়েটের সংবিধানে থাকা ‘বুয়েটে সকল রকম ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ’ এই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সংঘবদ্ধ এবং যে কোনো মূল্যে বুয়েটকে ছাত্ররাজনীতির হাত থেকে মুক্ত রাখতে বদ্ধপরিকর। আমরা আবারও সুস্পষ্ট করে বলতে চাই, আমাদের এসব দাবি কেবল কোনো বিশেষ ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনের বিরুদ্ধে নয়, বরং আমরা বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বুয়েটের সংবিধান অনুযায়ী সব রকম ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান করছি।

এ সময় শিক্ষার্থীরা ৫ দফা দাবি পেশ করে। দাবিগুলো হলো- ২৮ মার্চের মধ্যরাতে রাজনৈতিক সমাগমের মূল সংগঠক ইমতিয়াজ রাব্বি ‘বুয়েটে সকল রকম রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ’ এই নীতিমালা ভঙ্গ করার কারণে আমরা আজ সকাল ৯টার মধ্যে ইমতিয়াজ রাব্বির বুয়েট থেকে স্থায়ী বহিষ্কার এবং হল বাতিল। ওই ঘটনায় ইমতিয়াজ রাব্বির সঙ্গে বুয়েটের বাকি যেসব শিক্ষার্থী জড়িত ছিল স্থায়ী একাডেমিক এবং হল থেকে বহিষ্কারের দাবি। এ সময় শিক্ষার্থীরা ছবি এবং ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে চিহ্নিত করে একাংশের নাম প্রকাশ করে। তারা হলেন- এ এস এম আনাস ফেরদৌস (ওউ : ১৮১৮০০৪), মোহাম্মদ হাসিন আরমান নিহাল (ওউ : ২১০৬১০১), অনিরুদ্ধ মজুমদার (ওউ : ২১০৬০৭৯), জাহিরুল ইসলাম ইমন (ওউ : ২১১২০৩১) এবং সায়েম মাহমুদ সাজেদিন রিফাত (ওউ : ২১০৬১২৬)। এদের বাইরে বাকি আরও যারা জড়িত ছিল যাদের শনাক্ত করা যায়নি।

তাদের সবাইকেই যেন বুয়েট প্রশাসন অনতিবিলম্বে শনাক্ত করে এবং ওপরে উল্লিখিত অভিযুক্তদের মতোই একই মেয়াদে শাস্তির ব্যবস্থার দাবি জানান তারা।

বহিরাগত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ যারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করল তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তারা কেন কীভাবে প্রবেশ করার অনুমতি পেল এই ব্যাপারে সুস্পষ্ট সদুত্তর এবং জবাবদিহিতা নিয়ে লিখিত নোটিস এবং বাস্তবায়ন।

ডিএসডব্লিও (ছাত্রকল্যাণ দফতর) পরিচালক মিজানুর রহমানের দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদত্যাগ। আন্দোলনরত বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো রকম হয়রানিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না এই মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি প্রদান।

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শেষ হওয়ার পর সাংবাদিকদের উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, ‘ইমতিয়াজকে হল থেকে বহিষ্কার আমরা করতে পারি। কিন্তু টার্ম বহিষ্কার শৃঙ্খলা কমিটির বৈঠক ডেকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে করতে হবে। শৃঙ্খলা কমিটির সভার জন্য তদন্ত প্রতিবেদন লাগবে। তদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া শৃঙ্খলা কমিটি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। এভাবে শাস্তি দেওয়া হলে আদালতে গিয়েও টিকবে না। ফলে তদন্ত লাগবে এবং তদন্তে অভিযুক্তকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। আমাদের আইন ও নিয়ম অনুযায়ী চলতে হবে। আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। ছয় সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটিকে আগামী ৮ এপ্রিল পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর এর সদস্যদের মতামতও আমরা শুনব।’

শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর সঙ্গে সহমত পোষণ করে বেলা সোয়া ১টার দিকে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে উপাচার্য বলেন, দাবি পূরণ করার জন্য যা যা করার, করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন এলে আমরা নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। নিয়মের বাইরে আমি কিছু করতে পারব না। নিয়মবহির্ভূতভাবে একজনকে বহিষ্কার করলে সেটা আদালতে টিকবে না। নিয়মের মধ্যে সবকিছু করার জন্য সময়ের প্রয়োজন। যেহেতু রোজার মাস, সময় একটু বেশি দেওয়া উচিত ছিল।’

শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বর্জনের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা স্থগিত করিনি। তাঁরা (শিক্ষার্থী) বর্জন করেছেন। তাঁরা পরীক্ষা স্থগিতের আবেদনও করেননি। তাঁরা আবেদন করলে আমরা বিবেচনা করতাম। তাঁরা এখানে ভুল করেছেন। পরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু তাঁরা পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী ঘণ্টা বাজবে, ছাত্ররা আসুক না আসুক, এমন ঘটনা বুয়েটে আগেও ঘটেছে। পরে তাঁরা পরীক্ষার জন্য আবেদন করলে একাডেমিক কাউন্সিল বিবেচনা করতে পারে।’

ডিএসডব্লিউর পদত্যাগের দাবির বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘ডিএসডব্লিউর পদত্যাগের বিষয়ে এখন আমরা চিন্তা করছি না। কারণ, এটা নরমাল একটা প্রসিডিউর। নিয়ম অনুযায়ী যখন হওয়ার হবে। ডিএসডব্লিউ বলেছেন, তাঁর পক্ষ থেকে কোনো গাফিলতি ছিল না। শিক্ষার্থীরা দাবি করতেই পারেন। কিন্তু দাবির মুখে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না। সময় হলে আমরা নতুন ডিএসডব্লিউ নিয়োগ দেব। তার জন্য সময় প্রয়োজন। যদি কোনো নিরাপত্তারক্ষী বহিরাগত ব্যক্তিদের ঢুকতে দিয়ে থাকেন, তাঁর বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

বিকাল ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কয়েকটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত একদল শিক্ষার্থী ক্রমাগত বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন।

এ সময় কেমিক্যাল অ্যান্ড ম্যাটারিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০ ব্যাচের শিক্ষার্থী আশিক আলম, সাগর বিশ্বাস, অরিত্র ঘোষ ও ২১ ব্যাচের অর্ঘ্য দাস এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০ ব্যাচের শিক্ষার্থী তানভীর স্বপ্নীল উপস্থিত ছিলেন। আরও ২০-২৫ জন উপস্থিত হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বুলিংয়ের ভয়ে তারা অংশ নেননি বলে এই শিক্ষার্থীরা দাবি করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ করে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের ‘বুলিংয়ের’ কিছু স্ক্রিনশট সাংবাদিকদের প্রদান করেন তারা। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি বলে পরিচয় দেওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে অফলাইনে ও অনলাইনে নানাভাবে র‌্যাগিং ও বুলিংয়ের শিকার এবং নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন এই শিক্ষার্থীরা।

লিখিত বক্তব্যে ২০ ব্যাচের আশিক আলম বলেন, বুয়েটের সংবিধানে ক্যাম্পাসে সব ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের যে আইন আছে আমরা তাকে সম্মান করি। তবে এই সুযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে গোপনে হিযবুত তাহরীর, ইসলামী ছাত্র শিবিরের মতো নিষিদ্ধ সংগঠনগুলো কাজ করছে। আবরার ফাহাদের হত্যার ঘটনায় আমরাও দুঃখিত। তবে সে ঘটনার আবেগকে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামানো হয়েছে। যারা প্রগতিশীল রাজনীতি করে তাদের দমিয়ে রেখে হিযবুত তাহরীর বা এ ধরনের অন্ধকার রাজনীতি যারা করে সেটা মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ২০২৩ সালে সুনামগঞ্জে বুয়েটের ৩৪ শিক্ষর্থীকে গ্রেফতার করা হলে আমরা মৌলবাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করি। সে ঘটনায় আমাদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয় এবং ৭০-৮০ জন মিলে দুজনকে ডেকে ‘কালচারাল র‌্যাগিং’ দেওয়া হয়। কারও পরিবার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলে তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও পরিবার নিয়ে অশালীন মন্তব্য করা হয়। তাদেরকে নিয়মিত র‌্যাগিং, বুলিং, হুমকি ও ভয়ভীতির মধ্যে জীবন কাটাতে হয়। তিনি বলেন, চলতি বছরের ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিনে আমরা ইফতার বিতরণ করি, সেখানেও আমাদের একই অপবাদ দেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর