শিরোনাম
রবিবার, ৩১ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

এমপি মন্ত্রীদের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান

♦ উপজেলায় নিজের লোক জেতাতে প্রভাব বিস্তার মানা হবে না : কাদের ♦ কেন্দ্রের অনুমোদন ছাড়া উপজেলা কমিটি ভাঙা যাবে না

নিজস্ব প্রতিবেদক

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে এমপি-মন্ত্রীদের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগ। গতকাল সকালে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রংপুর বিভাগের আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় কেন্দ্রের পক্ষ থেকে এই বার্তা দেওয়া হয় সারা দেশে দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের। বৈঠক সূত্র এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে যত বড় প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রীই হোন না কেন, তারা যদি উপজেলা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেন, নিজের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে প্রার্থিতা ঘোষণা করেন অথবা নির্বাচনে প্রভাব ঘাটান তাহলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে একচুল ছাড় দিতে নারাজ আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। দলের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে।

দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের সভাপতিত্বে বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দীর পরিচালনায় বৈঠকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, অর্থমন্ত্রী আবুল হাছান মাহমুদ আলী, নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, কেন্দ্রীয় সদস্য আনিসুর রহমানসহ রংপুর জেলা, মহানগরসহ রংপুর বিভাগের দেড় শতাধিক নেতা এতে অংশ নেন। বেলা সোয়া ১১টায় শুরু হওয়া বৈঠক দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চলে।

বৈঠকের শুরুতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, উপজেলা নির্বাচনে এমপিরা হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। ফ্রি স্টাইলে দল চলতে পারে না। সংসদ সদস্যরা (এমপিরা) নির্বাচনে নিজের লোক জেতাতে প্রভাব বিস্তার করলে দল তা কোনোভাবেই মেনে নেবে না।

সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, উপজেলা নির্বাচন আপনাদের অনুরোধে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে আমরা ইউনিয়ন পর্যায়ে নৌকা দিয়েছি। এবার উন্মুক্ত করে দিয়েছি। কতটা প্রতিযোগিতামূলক, কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে তা দেখা হবে।

ওবায়দুল কাদের বলেন, যে উদ্দেশ্যে এই ইলেকশন উন্মুক্ত করা হয়েছে সে উদ্দেশ্য ব্যাহত করা যাবে না। প্রতিযোগিতা যারা করতে চায় করুক। কিন্তু এমপি-মন্ত্রী যারাই হস্তক্ষেপ করবেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আমরা চাই ইলেকশন সম্পূর্ণভাবে ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার করতে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে। নির্বাচনের আগে আশঙ্কা, আতঙ্ক ছিল, তা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কেটে গেছে।

সংগঠন যখন আছে সমস্যাও থাকবে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, আওয়ামী লীগ বড় দল। বড় দলে কখনো কখনো কিছু সমস্যা সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে নিতে বাধাগ্রস্ত করে। আমরা এবার প্রথম থেকেই আঁটঘাট বেঁধে নামতে চাই। নির্বাচনের পর থেকেই সাংগঠনিক কার্যক্রমে আমরা নজর দিয়েছি। কিছু কিছু জেলায় সমস্যার ব্যাপারে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছি। যার যেমন খুশি যখন তখন দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য রাখবেন, তার দায়িত্ব দল গ্রহণ করবে না। একটা দুটা বক্তব্য পুরো দলের শৃঙ্খলার ওপর আঘাত হানে। তাতে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, জনগণের সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে। জেলার সঙ্গে উপজেলা, উপজেলার সঙ্গে ইউনিয়নের সাংগঠনিক সেতু তৈরি করতে হবে। আমাদের যেখানে সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় ওয়াল আছে তা ভেঙে দিতে হবে।

কেন্দ্রের অনুমতি ছাড়া কেউ উপজেলা-থানা কমিটি দিতে বা ভাঙতে পারবে না : কেন্দ্রের নির্দেশ ছাড়া কেউ কোনো থানা বা উপজেলা কমিটি ভাঙতে পারবে না, গড়তে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে রংপুর বিভাগের জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের। জেলা নেতারা শুধু মাত্র সুপারিশ করতে পারবে কেন্দ্রে। অভিযোগের সত্যতা যাচাই-বাছাই করে কেন্দ্র প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ ছাড়া পূর্ণাঙ্গ কমিটি যেসব জায়গায় নেই সেখানে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে হবে। একইভাবে স্বতন্ত্র এমপি বনাম দলীয় এমপি কিংবা দলীয় প্রার্থীর মধ্যে যে কলহ চলে আসছিল তা নিরসনের তাগাদা দেওয়া হয়েছে।

জেলা-উপজেলা ধরে সমস্যা তুলে ধরা হয়। প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন দলের সাধারণ সম্পাদক। রংপুর জেলা ও মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে রংপুর মহানগর ছয় থানায় কমিটি গঠন নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে বিরোধ চলে আসছিল। বৈঠকে সেই বিরোধ নিরসনের পন্থা বের করা হয়েছে। একাধিক দলীয় সূত্রে জানা যায়, রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন উপস্থিত নেতারা। এ সময় কয়েকটি থানা কমিটি নিয়েও কথা হয়। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফাকে মহানগরের ছয থানার কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারাই কমিটি গঠন করবেন।

বৈঠক সূত্র জানায়, নীলফামারী জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা জলঢাকা উপজেলার সভাপতি/সাধারণ সম্পাদকের কোন্দলটি কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টিতে আনেন। একই সঙ্গে এই কমিটি ভেঙে দেওয়ার কথাও বলেন। তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, কারও নিজের ইচ্ছায় কোনো কমিটি গঠন করতে পারবেন না। আপনারা কোনো থানা/উপজেলা কমিটি গড়তেও পারবেন না, ভাঙতেও পারবেন না। আপনাদের কোনো কথা থাকলে কেন্দ্রের কাছে সুপারিশ করবেন- এই কারণে ওই কমিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আপনারা ভাঙবেন কেন? অনেক সময় দেখা যায় উপজেলা/থানা কমিটি ভেঙে দিয়েছে কিন্তু কেন্দ্র জানে না। আওয়ামী লীগে এটা হতে পারে না। আওয়ামী লীগ সম্পাদক বলেন, নিজের পকেট থেকে কমিটি করবেন, পকেটের কমিটি আমরা চাই না। কমিটি করবেন দলের দুঃসময়ের ত্যাগী নেতাদের দিয়ে। আজকে দুই পকেটে দুজন নেতা নির্বাচন, এই ধরনের নেতৃত্ব দলের কোনো কাজে আসবে না। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটি গঠন করতে হবে।

নিজের দলের ভিতরের শত্রু তাড়াতে হবে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ এই নেতা বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, আপন ঘরে যার শত্রু তার শত্রুতার জন্য বাইরের শত্রুর দরকার নেই। আপন ঘরের শত্রু তাড়াতে হবে। আপন ঘরে শত্রু রেখে কোনো দিনও স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য সফল হবে না। আমরা চ্যালেঞ্জিং টাইম অতিক্রম করছি জানিয়ে তিনি বলেন, এই সময় ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা অনেকেই বলে ফেলে, পত্রপত্রিকায় বের হয়। দায়িত্বশীল ব্যক্তি দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলতে পারে না। এটা সবাই মনে রাখবেন। বৈঠকে এসব আলোচনার বিষয়ে মুঠোফোনে রংপুরের স্বতন্ত্র এমপি জাকির হোসেন সরকার, জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছায়াদত হোসেন বকুল, মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধরণ সম্পাদক তুষার কান্তি ম লসহ একাধিক নেতা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এ ছাড়া নীলফামারী জেলার জলঢাকা ও সৈয়দপুরের কমিটি নিয়ে জটিলতা নিরসনে সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর ও বালিয়াডাঙ্গি আওয়ামী লীগের কমিটি নিয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাতকে বহিষ্কার করে অন্য একজনকে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করে আনোয়ার সাদাতকে পুনর্বহাল করা হয়। গাইবান্ধা জেলার স্বতন্ত্র এমপির সঙ্গে জেলার আওয়ামী লীগ নেতাদের সমস্যা তাৎক্ষণিকভাবেই সমাধান করা হয়।

স্বতন্ত্র এমপিদের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে হবে : বৈঠকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র এমপিদের বিষয়ে কথা ওঠে। নীলফামারীর এক নেতা অভিযোগ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এখন নৌকার লোক নিধনে নেমেছেন। তারা নৌকার পক্ষে যারা কাজ করেছিলেন তাদের কোনো ধরনের স্পেস দিচ্ছেন না। এভাবে চলতে পারে না। জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দলের বিশেষ প্রয়োজনে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিল। যারাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিল তারাও আমাদের দলের লোক। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করার প্রয়োজনেই এটা করা হয়েছিল। সে কারণে স্বতন্ত্র এমপিদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা চলবে না। তাদের সঙ্গে মিলেমিশেই চলতে হবে।

জানতে চাইলে রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সুজিত রায় নন্দী বলেন, ‘নীলফামারী জেলার কয়েকটি উপজেলার সমস্যা সমাধানে স্থানীয় সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রংপুর মহানগরের সমস্যা সমাধানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খানসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর অন্য উপজেলাগুলোর যে সমস্যা ছিল তা তাৎক্ষণিকভাবেই আমরা সমাধান করেছি।’

সর্বশেষ খবর