মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

সদকায়ে ফিতর আদায় যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

সদকায়ে ফিতর আদায় যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ

পবিত্র ঈদুল ফিতরের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলেই সদকায়ে ফিতরকে ‘সদকায়ে ফিতর’ বলা হয়। রমজানের শেষে সদকায়ে ফিতর আদায় করা গুরুত্বপূর্ণ এক ইবাদত। ইসলামের প্রতিটি বিধানের পেছনে মহান উদ্দেশ্য রয়েছে। অনুরূপ সদকায়ে ফিতর আদায়ের মাঝেও ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। শুধু তাই নয়, সদকায়ে ফিতর আদায়ের মাধ্যমে হতদরিদ্রের মাঝে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। সহায়-সম্বলহীনরা পায় একটু সহানুভূতি। কিছুটা হলেও দূর হয় অভাবগ্রস্তদের অভাব। পবিত্র ঈদে ধনী-গরিব সবার মাঝে খুশি ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া সদকায়ে ফিতরের মাধ্যমে রোজাদারের রোজাকে পরিশুদ্ধ করা হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘সেই-ই সফলতা লাভ করেছে, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে।’ সুরা আ‘লা: ১৩ হজরত কাতাদাহ রহ. বলেন, এই আয়াতে উল্লেখিত ‘তাঝাক্কা’ তথা ‘পরিশুদ্ধ হওয়া’ শব্দ দ্বারা সদকায়ে ফিতরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। শরিয়তে সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। যাতে রোজাদারদের রোজার যাবতীয় ভুলত্রুটি পরিশুদ্ধ করা যায় এবং গরিব লোকেরা আহারাদি পায়’ (মিশকাত ১৬০ পৃষ্ঠা)। ফিতরা বা সদকায়ে ফিতর সেই নির্ধারিত সদকা, যা ঈদের নামাজের আগে প্রদান করতে হয়। একে জাকাতুল ফিতরও বলা হয়। আমরা একে ‘ফিতরা’ নামে জানি। সদকায়ে ফিতর সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা দুজন ব্যক্তির মাঝে এক সা’ গম কিংবা এক সা’ খেজুর অথবা এক সা’ যব আদায় করে দাও। এই বিধানটি প্রত্যেকটি গোলাম, স্বাধীন, ছোট ও বড় ব্যক্তির ওপর ফরজ।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং : ২৩৬৬৩) হজরত রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম তা আদায়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন এবং এর নিয়ম-নীতি শিক্ষা দিয়েছেন। ঈদের দিন সকালে যিনি নিসাব পরিমাণ সম্পদের (সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা বা সমমূল্যের ব্যবসাপণ্যের) মালিক থাকবেন, তাঁর নিজের ও পরিবারের ছোট-বড় সবার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাযি. বর্ণনা করেন, ‘নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম-এর জামানায় আমরা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম ‘এক সা’ (তিন কেজি তিনশ গ্রাম প্রায়) খাদ্যবস্তু।’ তিনি বলেন, ‘তখন আমাদের খাদ্য ছিল যব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর।’ (বুখারি : খণ্ড: ১, ২০৪)। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সদকায়ে ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্যবস্তু, যেমন এক সা যব, এক সা খেজুর, এক সা পনির, এক সা কিশমিশ।’ (বুখারি : খণ্ড ১, ২০৫)। সদকায়ে ফিতরের জরুরি কিছু মাসায়েল।

১. সদকায়ে ফিতরের নিসাব জাকাতের নিসাবের সমপরিমাণ। অর্থাৎ কারও কাছে সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা তার সমমূল্যের নগদ অর্থ কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অতিরিক্ত সম্পদ ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় বিদ্যমান থাকলে তার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। জাকাতের মতো বর্ষ অতিক্রম হওয়া শর্ত নয়। (ফাতহুল ক্বাদির ২/২৮১)

২. ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে সদকায়ে ফিতর বা ফিতরা আদায় করা উত্তম। তবে সেই সময়ের আগেও অর্থাৎ রমজানেও আদায় করা যায়। ঈদে পরে আদায় করলেও তা আদায়  হয়ে যায়। (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৪/৩৮৩)

৩. সদকায়ে ফিতর আদায় করার সময় স্থানের ভিন্নতার কারণে মূল্য পার্থক্য ধর্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। বরঞ্চ যেই জায়গায় সদকায়ে ফিতর আদায় করবে সেখানকার মূল্য ধর্তব্য হবে। (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৪/৩৭৪)

৪. সদকায়ে ফিতর নিজের পক্ষ থেকে আদায় করা এবং পিতা হলে তার নিজ নাবালক সন্তানের পক্ষ থেকে আদায় করে দেওয়া ওয়াজিব। সাবালক সন্তান, স্ত্রী, চাকর-চাকরানি, মাতা-পিতার পক্ষ থেকে দেওয়া ওয়াজিব নয়। তবে সবার পক্ষ থেকে আদায় করলে আদায় হয়ে যাবে। হ্যাঁ, সাবালক সন্তান পাগল হলে তার পক্ষ থেকে আদায় করা ওয়াজিব। (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৪/৩৯৭)

৫. বিবাহিতা ছোট মেয়ে নিজে সম্পদশালী হলে সদকায়ে ফিতর তার সম্পদ থেকে আদায় করা। (ফাতাওয়া আলমগিরি, ১/১৮২)

৬. রমজানের শেষ দিনেও যে নবজাতক দুনিয়ায় এসেছে কিংবা কোনো ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে, তার পক্ষ থেকেও সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। (ফাতাওয়া আলমগিরি, ১/১৯২)

৭. কেউ ফিতরা আদায় না করে মৃত্যুবরণ করলে তার পক্ষ থেকে তার উত্তরাধিকারী দিলেও আদায় হয়ে যাবে। (রুদ্দুল মুহতার, ২/১০৬) আইম্মায়ে আরবা বা চার ইমামের সদকায়ে ফিতর সম্পর্কে বক্তব্য কী?

১. হজরত ইমাম আজম আবু হানিফা রহ.-এর মতে, অধিক মূল্যের দ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম; অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরিবদের বেশি উপকার হয়, সেটাই উত্তম ফিতরা। ২. হযরত ইমাম মালিক রহ.-এর মতে, খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম এবং খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ‘আজওয়া’ খেজুর দ্বারাই আদায় করা উত্তম। ৩. হযরত ইমাম শাফিঈ রহ.-এর মতে, হাদিসে উল্লিখিত বস্তুর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা আদায় করা উত্তম। ৪. হযরত ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ.-এর মতে, সাহাবায়ে কিরাম রাহ.-এর অনুসরণ হিসেবে খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম। এ ছাড়া সদকার ক্ষেত্রে ফকিহদের ইতেফাক বা ঐক্যমত হলো, ‘যা গরিবদের জন্য বেশি উপকারী তা দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম।’ (আল মুগনি, খণ্ড : ৪, ২১৯;। উল্লিখিত বস্তুগুলোর মূল্যে টাকায়ও আদায় করা যায় এবং অন্য কোনো বস্তু (যেমন পোশাক-আশাক, ঈদের বাজার প্রভৃতি) কিনেও দেওয়া যায়। মহান রব্বে কারিম আমাদের সঠিক নিয়মে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

সর্বশেষ খবর