বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

থমথমে বুয়েট ছাত্রলীগের চার কর্মসূচি

নিজস্ব প্রতিবেদক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ সংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আদেশ হাই কোর্ট স্থগিত করলেও এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ দুই মেরুতে অবস্থান করছে। এমন পরিস্থিতিতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাসজুড়ে সুনসান নীরবতা, শিক্ষার্থীরা নেই, কেবল দাফতরিক কাজকর্ম চলছে। গতকাল বুয়েটে এমন চিত্র দেখা গেছে। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের তেমন দেখা না গেলেও সোমবার তারা জানিয়েছেন, রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবিতে আন্দোলন চলবে। একই সঙ্গে উপাচার্যকে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আহ্বান জানাবেন শিক্ষার্থীরা। বুয়েট ছাত্ররাজনীতির বাইরে রাখতে গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গত সন্ধ্যায় ড. এম এ রশীদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ চিঠি পড়ে শোনান রাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

বুয়েটের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মো. ইমামুল হাসান ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, শিডিউল অনুযায়ী বুধবার (আজ) একটা পরীক্ষা আছে। এরপর ঈদের পর পরীক্ষা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে গত ৩০ ও ৩১ মার্চ দুটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি তারা। এই পরীক্ষা দুটি কবে হবে- এমন প্রশ্নে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, এ বিষয়ে একাডেমিক কাউন্সিল যেভাবে নির্দেশনা দেয়, সেভাবে আমরা রুটিন করব।

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি শুরুর ঘোষণা : বুয়েটে ‘নিয়মতান্ত্রিক’ ছাত্ররাজনীতির ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে চার দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে তারা। গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে বুয়েটের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তারা এই ঘোষণা দেন। এ সময় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান, ঢাবি শাখা সভাপতি মাজহারুল ইসলাম শয়ন ও সাধারণ সম্পাদক তানবীর হাসান সৈকতসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

তাদের ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- আবাসিক হলে রাব্বীর সিট ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বুয়েট শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি; আধুনিক, স্মার্ট ও পলিসি নির্ভর নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠার কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে বুয়েট শিক্ষার্থীদের মতামত আহ্বান ও তাদের সঙ্গে আলোচনা; সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-জঙ্গি কালোছায়া থেকে বুয়েটকে মুক্ত করতে সেমিনার ও সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজন এবং বুয়েটে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠকালে সাদ্দাম হোসেন বলেন, বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর ছাত্রলীগ তার নৈতিক ও সাংগঠনিক অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, প্রশাসন বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অতীতেও সমর্থন করেনি, বর্তমানেও করে না। বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পর পাঁচ বছর সেখানে ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রগামী ভূমিকা রাখা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এরূপ কর্মকাণ্ড কোনোমতেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। বুয়েটে আবারও ছাত্ররাজনীতি শুরু হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এই রাজনীতি অবশ্যই ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ, সেশনজট, র‌্যাগিং-বুলিং, দখল-বাণিজ্য ও হত্যা-সন্ত্রাসের ছাত্ররাজনীতি নয়। এই ছাত্ররাজনীতি হবে আধুনিক, যুগোপযোগী, বৈচিত্র্যময়-সৃষ্টিশীল, জ্ঞান-যুক্তি-তথ্য-তত্ত্বনির্ভর। সাদ্দাম হোসেন বলেন, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বুয়েট পরিচালিত হয়। ফলে সেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক নীতি ও জনগণের প্রচলিত আইন থাকতে হবে। তবে কোন কাঠামোতে বুয়েটে রাজনীতি থাকবে তা শিক্ষার্থীরাই নির্ধারণ করবে। আমরা বুয়েটের শিক্ষার্থীদের নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতির প্রতি আহ্বান জানাব। বুয়েটে কমিটি দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই আমরা পরবর্তী কর্মসূচি করব।

ছাত্ররাজনীতিমুক্ত রাখতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে শিক্ষার্থীদের খোলা চিঠি : বুয়েটকে ছাত্ররাজনীতির বাইরে রাখতে এবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি দিলেন বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গত সন্ধ্যায় ড. এম এ রশীদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ চিঠি পড়ে শোনান রাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলা হয়, আপনি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। সেই একই স্বপ্ন বুকে ধারণ করে আপনার গর্বের এই দেশসেরা প্রতিষ্ঠানে আমরা পড়ার সুযোগ করে নিয়েছি। পদ্মা সেতু নির্মাণে বুয়েট শিক্ষক এবং সাবেক শিক্ষার্থীদের অবদান অনবদ্য। ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাতের একটি বক্তব্য উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন অধ্যাদেশ করে শিক্ষকদের রাজনীতি, রাজনৈতিক কার্যকলাপ ইত্যাদির অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের জন্য অধ্যাদেশের খসড়া যখন বঙ্গবন্ধুর সামনে উপস্থাপন করা হয়, তখন তিনি বলেছিলেন যে এই দুটো বিশ্ববিদ্যালয় নষ্ট করা চলবে না। খসড়া অর্ডিন্যান্স বঙ্গবন্ধু ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বুয়েটের শিক্ষকরা তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন। এই এজেন্ডাতে তিনি দেখা করতে রাজি হননি। তখন শিক্ষকরা কথা বলতেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলীর সঙ্গে। পূর্বে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির সক্রিয় ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীরা বলেন, বিগত বছরগুলোতে আমরা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির নামে ক্ষমতার নেতিবাচক দিকগুলোই প্রত্যক্ষ করেছি। ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মাঝে সূচনা ঘটেছে আধিপত্য, দাপট, র‌্যাগিং, শিক্ষকদের অপমান, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নিপীড়ন, খুনোখুনিতে মেতে ওঠার মতো ঘটনা এবং এর ব্যাপ্তি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এর চরমতম মূল্য হিসেবে আমরা আমাদের কেমিকৌশল এর সাবেকুন্নাহার সনি, যন্ত্রকৌশল এর আরিফ রায়হান দ্বীপ এবং সর্বশেষ তড়িৎকৌশল’১৭ এর আবরার ফাহাদকে হারিয়েছি। শিক্ষার্থীরা বলেন, ছাত্ররাজনীতিবিহীন বুয়েটের পরিবেশ ছিল সর্বোচ্চ নিরাপদ ও শিক্ষাবান্ধব। মৌলবাদী শক্তিকেও রুখে দিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রীকে নিজেদের অভিভাবক দাবি করে বুয়েট শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা নিজেদের মেধা ও শ্রমের সবটুকু দিয়ে বিজ্ঞানের অবাক করা দুনিয়ার একটা অংশের নেতৃত্বে বাংলাদেশকে দেখতে চাই। আমরা ত্রাসের রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝি না, আমরা শুধু দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে জানি। নিজেদের কাজ দিয়ে তা আমরা প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর। এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে দেশ মাতা আখ্যা দিয়ে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে হলেও বুয়েটকে রাজনীতিমুক্ত রাখতে এবং নিজেদের পাশে থাকার জন্য অনুরোধ জানান তারা।

 

 

সর্বশেষ খবর