২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা পার্কের বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। এ হামলায় ঘটনাস্থলেই মারা যান নয়জন। হাসপাতালে আরও একজন। নির্মম এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা দুটি মামলার বিচার শেষ হয়নি দীর্ঘ ২৩ বছরেও। হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতের রায়ের পর ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) অপেক্ষায় ৯ বছর ধরে ঝুলছে হাই কোর্টে। বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলাটি এখনো নিম্ন আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানান, ২০১৪ সালে হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতের রায়ের পর ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাই কোর্টে আসে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ মামলার পেপারবুকও (রায়সহ সব নথি-সংবলিত বই) তৈরি করা হয়। কয়েক দফা আদালতও পরিবর্তন হয়েছে। এর পর থেকে এ মামলার কার্যক্রম আর এগোয়নি। বর্তমানে মামলাটি বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান ও বিচারপতি মো. আলী রেজা সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চে বিচারাধীন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ শামীম খান জানান, গত মাসে মামলাটি শুনানির জন্য আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছিল। আদালত ঈদের চলমান ছুটি শেষে মামলাটি উপস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। চলতি মাসেই এর শুনানি শুরু হতে পারে। এ মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ শুনানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। পেপারবুকও প্রস্তুত। এখন প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দিলেই গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার ডেথ রেফারেন্স শুনানি শুরু হবে। আশা করছি দুই মাসের মধ্যেই মামলাটি হাই কোর্টে রায়ের পর্যায়ে আসবে। ঢাকার আদালত সূত্রে জানা গেছে, হাই কোর্টের স্থগিতাদেশের কারণে দীর্ঘদিন বিস্ফোরক মামলার বিচারকাজ থমকে ছিল। ওই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের পর ২০২১ সালে ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষের তৎপরতায় ৮৪ সাক্ষীর মধ্যে ৫৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ ওই ট্রাইব্যুনালেই সম্পন্ন হয়েছে। তবে দ্রুত বিচার আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বেশি থাকায় গত বছরের মার্চে বিস্ফোরক মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর সপ্তম আদালতে পাঠানো হয়। বর্তমানে ওই আদালতে মামলার বিচার থমকে আছে। জানা গেছে, মামলাটি বর্তমানে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারা অনুযায়ী আসামি পরীক্ষা করার জন্য দিন ধার্য রয়েছে। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে আসামিদের আদালতে হাজির করা হচ্ছে না। ফলে এ মামলার কার্যক্রম একরকম বন্ধই রয়েছে।
জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মো. মাহাবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাক্ষী না আসায় মামলার শুনানি হচ্ছে না। আরও দু-তিনজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। নয় তো আসামিরা এর সুযোগ নিতে পারে। তিনি বলেন, শিগগিরই সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করার পাশাপাশি আসামিদের ৩৪২ ধারা পরীক্ষার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ উদ্যোগ নেবে।মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান ‘ইসলামবিরোধী’ বিবেচনা করে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালানো হয়। হামলায় ঘটনাস্থলেই নয়জনের মৃত্যু হয়। পরে হাসপাতালে মারা যান একজন। এ ঘটনায় নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট অমল চন্দ্র ওই দিনই রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন। ঘটনার প্রায় আট বছর পর ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আলোচিত এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা বারবার পরিবর্তন, সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল, বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও তদন্ত কর্মকর্তাদের আদালতে সাক্ষ্য দিতে না আসার কারণে বিচার শুরু হতে দেরি হয়। পর্যায়ক্রমে থানা, ডিবি ও সিআইডি পুলিশে মামলার তদন্ত যায়। মামলার অষ্টম তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক আবু হেনা মো. ইউসুফ ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। দুটি মামলারই অভিযোগপত্র একসঙ্গে দাখিল করা হয়। পরে বিচারের জন্য মামলা দুটি ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে যায়। ওই আদালতে একই বছর ১৬ এপ্রিল পৃথক মামলা দুটিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের সিদ্ধান্তে হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ পাঠানো হয়। বিচার শেষে ২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মুফতি আবদুল হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় ছয় আসামিকে। মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ডও দিয়েছেন আদালত। এ মামলায় ১৪ আসামির চারজন শুরু থেকেই পলাতক। এরপর ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের জেল আপিল ও ফৌজদারি আপিলের শুনানির জন্য মামলাটি হাই কোর্টে আসে।