শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা
সিপিডির ‘বাংলাদেশের ৫০ বছর’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনেরা

দুর্নীতি অতিধনী তৈরির কারখানা

♦ কোনো কার্যকর প্রতিষ্ঠান নেই : রেহমান সোবহান ♦ সস্তা শ্রমের অর্থনীতির ফাঁদে দেশ : হোসেন জিল্লুর রহমান ♦ ভবিষ্যৎ বন্ধক রেখে উন্নয়ন হচ্ছে : জাহিদ হোসেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

দুর্নীতি অতিধনী তৈরির কারখানা

সিপিডির অনুষ্ঠানে গতকাল বিশিষ্টজনেরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দুর্নীতি এখন অতিধনী তৈরির কারখানা হিসেবে গড়ে উঠেছে। দেশে গরিবের উন্নতি হচ্ছে শামুকের গতিতে আর ধনীর উন্নতি রকেট গতিতে। কৃষি, তৈরি পোশাক খাত ও রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। এ উন্নতি প্রথাগতভাবে, বিস্ময়কর গতিতে নয়। এ ছাড়া দ্বিতীয় প্রজন্মের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। রাজধানীতে গতকাল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত বাংলাদেশের ৫০ বছর নিয়ে ‘ফিফটি ইয়ার্স অব বাংলাদেশ : ইকোনমি, পলিটিকস, সোসাইটি অ্যান্ড কালচার’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। বইটি সম্পাদনা করেছেন সিপিডির চেয়ারম্যান প্রফেসর রেহমান সোবহান ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. রওনক জাহান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান। বক্তৃতা করেন সিপিডির ফাউন্ডিং চেয়ারম্যান প্রফেসর রেহমান সোবহান, সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান, বিশ্বব্যাংকের সাবেক বেসরকারি খাত বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ আখতার মাহমুদ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ, আইএলওর সাবেক উপদেষ্টা ড. রিজওয়ানুল ইসলাম, ব্রুনাইয়ের দারুস সালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. ইফতেখারুল ইকবাল, ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও লেখক ড. সেলিম জাহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারনিউমারারি প্রফেসর ড. ফকরুল আলম, ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো ড. সোহেলা নাজনীন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ফেরদৌস আজিম ও দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের এমডি মাহরুখ মহিউদ্দিন।

প্রফেসর রেহমান সোবহান বলেন, দেশে কোনো কার্যকর প্রতিষ্ঠান নেই। আমরা উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি; কিন্তু আমাদের প্রতিষ্ঠানের ফাঁক এবং ক্রমাগত দুর্বলতা রয়ে গেছে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনার অবনতি প্রত্যক্ষ করছি, খেলাপি ঋণ একটি গুরুতর সংকটে রূপ নিয়েছে। ৫০ বছরে বাংলাদেশের সফলতা চোখে পড়ার মতো। এ সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে আর্থসামাজিক উত্তরণ ঘটেছে। এর আগে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ নিয়ে এ রকম আরেকটি বই করা হয়েছিল, তখন ২৫ বছরের বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে এত উচ্চাশা ছিল না। সেখানে গার্মেন্ট সেক্টরে কতগুলো ভ্যালু অ্যাড হতে পারে, সে বিষয়ে চিন্তা করা যায়নি। এখন ব্যাকওয়ার্ড শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বেশির ভাগ কাপড় দেশে তৈরি হচ্ছে। রেমিট্যান্স নিয়ে এত চিন্তাভাবনা করা হয়নি। আমাদের রেমিট্যান্স এখন ২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এখন পরবর্তী ২৫ বছরে এসব পার্থক্য খুঁজে বের করা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় রয়েছে। শুধু প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে নয়, দারিদ্র্য হ্রাস, মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রেও এগিয়েছে বাংলাদেশ।

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, আমার লেখায় রাজনীতির পুরো বিষয়টাতে একটি টেবিল আছে দুর্নীতি নিয়ে। মজার ব্যাপার হলো, দুর্নীতি কেন রাজনৈতিক আলোচনায়। এখানে দুর্নীতি তিনটি অ্যাসপেক্টে তুলে ধরেছি। প্রথমত দুর্নীতি অতিধনী তৈরির কারখানার উৎস হিসেবে গড়ে উঠেছে। আগে দুর্নীতি করত সুবিধার জন্য। আর এখন দুর্নীতি হচ্ছে রক্ষা করার জন্য। তাই আগামীতে অর্থনীতির উপযুক্ত এজেন্ডাই হবে রাজনীতির এজেন্ডা। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এখন আটকে গেছে সস্তাশ্রমের অর্থনীতির একটা ট্র্যাপের মধ্যে। ফিলিপাইন ও ব্রাজিলের উদাহরণ দেওয়া হলো। আমরাও কিন্তু সে ধরনের ট্র্যাপের মধ্যে আটকে গেছি, তার সঙ্গে শিক্ষা জড়িত আছে। অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক বেসরকারি খাত বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ আখতার মাহমুদ বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়েছে কৃষি, তৈরি পোশাক খাত আর প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভর করে। দেশের উদ্যোক্তা ও বাজার গবেষণা, নীতিনির্ধারণ, আলোচনা ও সংলাপ সমন্বয়ের ফলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সত্ত্বেও গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে। ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশ মধ্যম আয় বা ঋণের ফাঁদে পড়ে কি না সেটাই এখন প্রশ্ন। আমাদের এখন উচ্চ প্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদন ও রপ্তানির দিকে যেতে হবে। কিন্তু ১০ বছর ধরে উচ্চ প্রযুক্তিতে পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি ১ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের পর দ্বিতীয় প্রজন্মের চ্যালেঞ্জ শুরু হবে। সেজন্য এখনই প্রস্তুতি প্রয়োজন।

ড. সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার উন্নতি হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। তবে আরও উন্নতির জন্য নতুন নতুন চালিকাশক্তি নিয়ে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে দুর্নীতি রোধ ও অর্থনৈতিক সংস্কারে জোর দিতে হবে। এম এম আকাশ বলেন, দেশে চরম দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বাড়ছে। দেশে গরিবের ক্ষেত্রে উন্নতি হচ্ছে শামুকের গতিতে আর ধনীর উন্নতি রকেট গতিতে। দেশের উন্নয়ন নিয়ে যখন কথা হয়, তখন গড় সূচক নিয়ে কথা হয়। কিন্তু প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। ড. রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে শ্রমের প্রকৃত ব্যবহারের কারণে। কৃষির উন্নতি হয়েছে বিশেষ করে উচ্চফলনশীল জাতের ধানের আবাদ করায়। এ ছাড়া তৈরি পোশাক খাত, বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ায় উন্নয়ন হচ্ছে। তবে বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করে সবচেয়ে কম মজুরি পায় বাংলাদেশিরা। প্রফেসর ইফতেখারুল ইকবাল বলেন, বাংলাদেশের চাষাবাদে ব্যবহৃত পানির ৮০ ভাগই ভূগর্ভস্থ। তবে দিন দিন এ পানির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এদিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, স্বাধীনতার ৫২ বছরে বাংলাদেশের অনেক ইতিবাচক অর্জন রয়েছে। বিশৃঙ্খলা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাধাবিপত্তির পরও অনেক সূচকে দেখার মতো অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু উন্নয়ন হয়েছে দেশের ভবিষ্যৎ বন্ধক রেখে। ফিউচারটাকে মর্টগেজ করা হয়েছে। তিনি বলেন, একই সময়ে নেতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে প্রধানতম হলো বৈষম্য। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি যুগ মিলে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, বর্তমান বৈষম্য তাকেও ছাড়িয়ে গেছে। জাহিদ হোসেন বলেন, দেশে উন্নয়ন হয়েছে, এর পেছনে কাজ করেছে জনশক্তি। মানুষ কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যে উৎপাদনের মাধ্যমে উন্নয়ন করেছে, এগিয়ে নিয়েছে। আবার প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে তারা সহায়ক হয়েছে। একক এবং সমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে এটি হয়েছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতির একটি শ্রমনিবিড়ি সম্প্রসারণ ঘটেছে। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যে সংস্কার এ উন্নয়নের ধারা সচল রাখতে সহায়তা করেছে। বইটির আলোচনা করে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, বইতে কর্তৃত্ববাদী দলের রাষ্ট্র হিসেবে শাসনে এলিটরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এতে নির্বাচনি অনিয়শ্চতা, সিভিল সোসাইটির সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ সামাল দেওয়া সহজ হয়। গত কয়েক দশকে ব্যক্তি খাতে ব্যবসাবাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের সমন্বিত উদ্যোগের ক্ষমতা কমেছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান বলেন, এর আগে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সম্পর্কে এ রকম আরেকটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে আরও ভালো জায়গায় যাবে; কিন্তু অর্থনীতি নিয়ে এতটা উচ্চাকাঙক্ষা ছিল না। এখন রাজনীতি নিয়ে হতাশা আছে; তবে অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে।

সর্বশেষ খবর