শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

ইরানে এবার ইসরায়েলি হামলা

♦ টার্গেটে ছিল সেনাবিমান ঘাঁটি ও পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র ♦ ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, ধ্বংস করা হয়েছে ড্রোন : তেহরান

প্রতিদিন ডেস্ক

ইরানে এবার ইসরায়েলি হামলা

ইরানের ইস্পাহান শহরের একটি পারমাণবিক স্থাপনার নিরাপত্তায় নিয়োজিত সামরিক বাহিনীর সদস্যরা

ইসরায়েল আকস্মিকভাবে ইরানের ওপর হামলা চালিয়েছে। ১৪ এপ্রিল ইরানি হামলার পাল্টা হিসেবে গতকাল গ্রিনিচ মান সময় দুপুর সাড়ে ১২টার (বাংলাদেশের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৬টা) দিকে ইরানের তৃতীয় বৃহত্তম নগরী ইস্পাহানে ড্রোন হামলা চালায় ইসরায়েল। তবে হামলায় ব্যবহৃত ৩টি ড্রোনই ধ্বংস করে দিয়েছে ইরানের আকাশ সুরক্ষা ব্যবস্থা। ধারণা পাওয়া গেছে, ইসরায়েলি হামলার টার্গেট ছিল রাজধানী তেহরান থেকে ৩৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ইস্পাহানে ইরানি সেনাবাহিনীর বেশ বড় একটি বিমান ঘাঁটি ও বেশ কয়েকটি পরমাণু স্থাপনা কেন্দ্র। তেহরান বলেছে, ইসরায়েলি হামলায় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, হামলাকারী ড্রোনগুলোকে আকাশেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়। সূত্র : আল জাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স।

আমেরিকার সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজের খবরে বলা হয়, ভোরে ইসরায়েল ইরানের ‘নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু’তে হামলা চালিয়েছে। ইরানের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ইসফাহানে বিস্ফোরণের খবর দেওয়া হয়েছে। ইরান সরকার ইসরায়েলি হামলার কথা স্বীকার করে কয়েকটি ড্রোনকে গুলি করে ধ্বংসের দাবি করেছে।

এদিকে ইরানের আধা সরকারি সংবাদ সংস্থা ফার্স নিউজ জানায়, ইসরায়েলি হামলার সময় ইরানের ইসফাহান প্রদেশে জোরালো বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। এ সময় ইরানের বেশ কয়েকটি শহরের বিমান ওঠানামার কাজ সাময়িক বন্ধ রাখা হয়। এ ছাড়া সিরিয়া ও ইরাক থেকেও বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাওয়া গেছে। ইরানের সরকারি বার্তা সংস্থা ইরনা জানিয়েছে, সিরিয়ার বিভিন্ন সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এ ছাড়া ইরাকের বাবেল অঞ্চলের আল-ইমাম এলাকা থেকেও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘হামলাগুলো চালিয়েছে ইসরায়েল। ইরানে হামলার সময় ব্যবহার করা হয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন।’ তবে ইরানের পক্ষ থেকে শুধু ড্রোনের কথা বলা হয়েছে। ইরানের সেনাবাহিনীর শীর্ষ কমান্ডার মেজর জেনারেল আবদুুল রহিম মৌসাভি জানিয়েছেন, ইসফাহানে যেসব বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো ড্রোন ধ্বংস করার শব্দ ছিল। তিনি জানিয়েছেন, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে এসব ড্রোন ভূপাতিত করা হয়। তবে এগুলো ইসরায়েল থেকে ছোড়া হয়নি। দেশটির এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে বলেছেন, ইসফাহানে যেসব ড্রোন ধ্বংস করা হয়েছে সেগুলো ইসরায়েল থেকে ছোড়া হয়েছে- এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার বহিঃ সূত্র এখনো নিশ্চিত হয়নি। আমরা বাইরের কোনো হামলার স্বীকার হইনি। এখন মূলত হামলার বদলে অনুপ্রবেশ নিয়ে আলোচনা চলছে।’ ইরানের মহাকাশ সংস্থার মুখপাত্র হোসেইন দালিরিয়ান বলেছেন, ‘দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সফলভাবে কয়েকটি মাইক্রো ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি।’ দালিরিয়ান বলেন, কোয়াডকপ্টার উড়িয়ে শত্রুরা ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছে যা তাদের নিজেদের জন্যই অপমানজনক। এসব কোয়াডকপ্টারকে ধ্বংস করা হয়েছে।’ এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএ জানিয়েছে, ‘ইরানের সব পরমাণু কেন্দ্র ও স্থাপনা নিরাপদে রয়েছে। সেখানে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আইএইএ নিবিড়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।’ এদিক, ইরানের বিমানবন্দর এবং এয়ার নেভিগেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, স্বল্প বিলম্বের পর রাজধানী তেহরানের ইমাম খোমেনি (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং তেহরানের মেহরাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ ইরানের সব বিমানবন্দরে বিমান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। এখন স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে ইরানের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রয়েছে। কারও মধ্যে কোনো ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই।

এদিকে ইসরায়েলি ড্রোন হামলার পর হুমকি দিয়ে ইরানের সামরিক বাহিনীর এলিট শাখা ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) বলেছে, ‘যদি দেশটির পরমাণু স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে কোনো হামলা চালায়, তাহলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।’ পারমাণবিক স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বপ্রাপ্ত আইআরজিসি টিমের প্রধান জেনারেল আহমেদ হাকতালাব এক বার্তায় বলেছেন, ‘ইসরায়েল যদি সত্যিই পরমাণু স্থাপনায় হামলা করে, তাহলে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে।’

সিরীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ইসরায়েলের হামলা : সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে একটি আকাশ প্রতিরক্ষা ইউনিটকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। গতকাল সিরীয় সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে এ দাবি করে। ব্রিটেনভিত্তিক সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস বলেছে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলাটি সরকারি বাহিনীর একটি সামরিক রাডারে আঘাত হেনেছে। তবে কেউ হতাহত হয়েছে কি না তা স্পষ্ট নয়। অবজারভেটরি প্রধান রামি আবদুর রহমান বলেছেন, ছয়টি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান সিরীয় আকাশসীমায় প্রবেশ করেছে। রাডার যখন এগুলোকে শনাক্ত করে তখন পূর্ব দিকে উড়ছিল।

বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়া : বেশ কয়েকটি দেশ ইসরায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ওমানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, তার দেশ ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরানের ইস্পাহানে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানায়। মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ অঞ্চলে সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা প্রসারিত করার পরিণতি সম্পর্কেও সতর্ক করেছে মিসর। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে, এমন পদক্ষেপ থেকে যেন দুই পক্ষই বিরত থাকে। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত- গাজায় গণহত্যা বন্ধ করা এবং একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করা।

ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্তোনিও তাজানি উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরএআইকে বলেন, ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এড়াতে আমরা সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাই। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেন, এটি চলমান পরিস্থিতি। পুরো ঘটনা সম্পর্কে পরিষ্কার হওয়ার আগে কিছু বলা ঠিক হবে না। মিত্রদের সঙ্গে মিলে আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা এড়াতে উভয়পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এ অঞ্চলে দুই পক্ষকে উত্তেজনা থেকে দূরে রাখতে আমাদের সবকিছু করতে হবে। অঞ্চলটি স্থিতিশীল থাকা এবং সব পক্ষের পরবর্তী পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকা একান্ত প্রয়োজন।

জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইএইএ নিশ্চিত করেছে যে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আইএইএ প্রধান রাফায়েল গ্রোসি চূড়ান্ত সংযমের আহ্বান জানান এবং বলেন, সামরিক সংঘাতে পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষবস্তু হওয়া উচিত নয়। এক্সে দেওয়া পোস্টে তিনি বলেন, আইএইএ পরিস্থিতি কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছে। নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হ্যাঙ্কে ব্রুইনস স্লট বলেন, ইরানে পরিস্থিতি নেদারল্যান্ডস কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছে। মধ্যপ্রাচ্যে সর্বসাম্প্রতিক ঘটনা গভীর উদ্বেগের। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, চীন প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো চিহ্নিত করেছে এবং উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে এমন যে কোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি নিয়ে সতর্ক করে বলেছেন, প্রত্যেককেই এখন নিশ্চিত করতে হবে, অদূর ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যে যেন আর কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। ক্রেমলিন বলেছে, ইরানে ইসরায়েলের হামলার তথ্য বিশ্লেষণ করছে রাশিয়া। উভয় পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে দেশটি। এ ছাড়া জাপান, সুইডেন, কানাডা ফ্রান্সও উদ্বেগ প্রকাশের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে।

সর্বশেষ খবর