শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা
ভারতে লোকসভা নির্বাচন

কড়া নিরাপত্তায় প্রথম দফা ভোট গ্রহণ

২৬ এপ্রিল দ্বিতীয় দফা

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

ভারতে লোকসভা (সংসদের নিম্নকক্ষ) নির্বাচনের প্রথম দফায় গতকাল ভোট নেওয়া হয়েছে। বিক্ষিপ্ত কিছু অশান্তি ও সহিংসতা ঘটলেও নির্বাচন মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই হয়েছে। এ পর্বে লোকসভার ১০২ আসনে ভোট নেওয়া হয়। এসব আসন এলাকা দেশটির ১৭ রাজ্য ও চার কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের অন্তর্গত। সাত দফায় হবে লোকসভা নির্বাচন। দ্বিতীয় দফায় ২৬ এপ্রিল, তৃতীয় দফায় ৭ মে, চতুর্থ দফায় ১৩ মে, পঞ্চম দফায় ২০ মে, ষষ্ঠ দফায় ২৬ মে এবং সপ্তম বা শেষ দফার ভোট ১ জুন। এর মধ্যে প্রথম দফাতেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আসনে ভোট নেওয়া হয়। ভোট গণনা ৪ জুন। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করতে কর্তৃপক্ষ কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল। কেন্দ্রগুলোয় কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের মোতায়েনের পাশাপাশি কুইক রেসপন্স টিম (কিউআরটি), হেভি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড, ওয়েবক্যাম, ড্রোনের মাধ্যমেও ভোট প্রক্রিয়ার ওপর নজর রাখছে নির্বাচন কমিশন।

প্রথম দফায় ভোট হয়েছে তামিলনাড়ুর ৩৯, রাজস্থানের ১২, উত্তর প্রদেশের ৮, মধ্যপ্রদেশের ৬, উত্তরাখণ্ডের ৫, মহারাষ্ট্রের ৫, অসমের ৫, বিহারের ৪, পশ্চিমবঙ্গের ৩, অরুণাচলের ২, মণিপুরের ২, মেঘালয়ের ২, ছত্রিশগড়ের ১, মিজোরামের ১, নাগাল্যান্ডের ১, সিকিমের ১, ত্রিপুরার ১, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ১, লাক্ষাদ্বীপের ১, পঁদুচেরির ১ এবং জম্মু-কাশ্মীরের ১ আসনে। সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ভোট নেওয়া হয়েছে।

অশান্তি-সহিংসতা : পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায় চান্দামারী এলাকায় তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের ছোড়া পাথরের আঘাতে বিজেপি বুথ সভাপতি লব সরকার আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ বিজেপির। হাসপাতালে ভর্তি ওই বিজেপি নেতা। এ ছাড়া নাটাবাড়ি এলাকায় তাদের আরও বেশ কয়েকজন কর্মী-সমর্থকের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। তাদের তুফানগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তৃণমূলের পাল্টা অভিযোগ, কোচবিহারের বিজেপি প্রার্থী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীত প্রামাণিক তাঁর পদের অপব্যবহার করে দলীয় কার্যালয়ে অস্ত্র মজুদ করেছেন। শীতলকুচিতে দুর্বৃত্তদের আঘাতে এক সাধারণ ভোটারের চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আলিপুরদুয়ারে তৃণমূলের বুথ এজেন্টের ওপর হামলা, তুফানগঞ্জ-২ ব্লকের হরিরহাট এলাকায় দলের অস্থায়ী কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ, তৃণমূল নেতা এবং তৃণমূলের বেতাগুড়ি ব্লক প্রেসিডেন্ট অনন্ত বর্মণের ওপরও হামলার অভিযোগ তুলেছে তৃণমূল। নির্বাচনি সহিংসতাসহ বিভিন্ন ঘটনায় দুই পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে।

বিক্ষিপ্ত অশান্তির ঘটনা ঘটেছে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য মণিপুরেও। রাজ্যটির রাজধানী ইম্পলে বেশ কিছু কেন্দ্রে বুথ দখল, ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট মেশিন নষ্ট করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। মইরাং বিধানসভা কেন্দ্রের অধীন থামানপোকপি এলাকায় একটি ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে গুলি চালানোর অভিযোগ দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে। তাতে তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। এর পরই অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। ওই ঘটনার ২৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যেখানে প্রথমে দুটি গুলির শব্দ শোনা যায়, পরে আরেকটি গুলির শব্দ শোনা যায়। ইম্ফল ইস্ট জেলার থাঙ্গজু বিধানসভা কেন্দ্রের অধীন একটি কেন্দ্রে যথেচ্ছ ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে। খঙ্গমান এলাকায় একটি বুথে ঢুকে দুর্বৃত্তরা নির্বিচারে ছাপ্পা ভোট দিতে থাকে। মাওবাদী অধ্যুষিত ছত্তিশগড়ের বাস্তার লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত একটি জায়গায় বিস্ফোরণে এক সিআরপিএফ কমান্ড্যান্ট আহত হয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, বিজাপুর জেলার মাওবাদীদের রাখা ‘ইমপ্রুভাইসড এক্সক্লুসিভ ডিভাইস (আইইডি)-এ ওই সিআরপিএফ কর্মকর্তা আহত হন। ওই ঘটনার পর সেখানে সিআরপিএফ জওয়ান মোতায়েন করা হয়েছে। বিস্ফোরণে আসামে ইভিএম বহনকারী একটি গাড়ি নদীতে ডুবে যায়। ফেরি পারাপারের সময় নদীতে পানির স্তর বেড়ে যাওয়ায় ওই গাড়িটির আংশিক ডুবে যায়।

ভাগ্য নির্ধারণ : এ দফায় দেশজুড়ে ১ হাজার ৬২৫ প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ হবে। এর মধ্যে পুরুষ ১ হাজার ৪৯১ এবং নারী ১৩৪ জন। গোটা দেশে হেভিওয়েট প্রার্থীর মধ্যে রয়েছেন আটজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, দুজন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী, একজন সাবেক রাজ্যপাল। এর মধ্যে অন্যতম সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নীতীন গড়কড়ি (নাগপুর কেন্দ্র), কেন্দ্রীয় ভূবিজ্ঞান ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী কিরেন রিজিজু (অরুণাচল পশ্চিম), কেন্দ্রীয় জাহাজ মন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল (দিব্রুগড়) ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিজেপি প্রার্থী নিশীত প্রামাণিক (কোচবিহার)। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের ছেলে কংগ্রেসের কার্তি চিদাম্বরম (শিবগঙ্গা), কংগ্রেস নেতা গৌরব গগৈ (জোড়হাট), লোকজনশক্তি পার্টির প্রধান চিরাগ পাসওয়ান (জামুই), ডিএমকে প্রার্থী কানিমোঝি করুণানিধি (থুট্টুকুড়ি) ও ডিএমকে প্রার্থী দয়ানিধি মারাণ (চেন্নাই সেন্ট্রাল)। ভোট শুরুর আগেই যুবসমাজ এবং নতুন ভোটারদের উদ্দেশে বার্তা দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি এক্স হ্যান্ডলে বেশি বেশি সংখ্যায় বেরিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান জানান।

পশ্চিমবঙ্গ : রাজ্যের মোট ৪২ লোকসভা আসনের মধ্যে গতকাল প্রথম দফায় ভোট নেওয়া হয় কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি কেন্দ্রে। তিনটি কেন্দ্রেই ত্রিমুখী লড়াই (তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি ও বাম-কংগ্রেস জোট) হলেও নজর থাকবে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস ও প্রধান বিরোধী দল বিজেপির দিকে। গত নির্বাচনে এ তিনটি আসনই বিজেপির দখলে ছিল, দ্বিতীয় স্থানে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। এবার কোচবিহার কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী করেছে এ কেন্দ্রের বর্তমান সাংসদ এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীত প্রামাণিককে। তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেসের জগদীশ চন্দ্র বর্মা বসুনিয়া। এ ছাড়া লড়াইয়ের ময়দানে রয়েছেন ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী নীতীশ চন্দ্র রায় এবং কংগ্রেসের পিয়া রায়চৌধুরী।

আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী মনোজ টিগ্গা, তৃণমূল কংগ্রেসের প্রকাশ চিক বারিক, আরএসপির মিলি ওঁরাও। গতবার এ কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে জয় পেয়ে সাংসদ হয়েছিলেন জন বার্লা। কিন্তু এবার তাঁকে প্রার্থী করেনি দল।

জলপাইগুড়ি আসনে বিজেপির প্রার্থী বর্তমান এমপি জয়ন্ত কুমার রায়, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেসের নির্মল চন্দ্র রায় এবং সিপিআইএমের দেবরাজ বর্মণ।

এদিন সকাল থেকেই কেন্দ্রগুলোয় লম্বা লাইন দেখা গেছে। মূলত দুপুরের প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ এড়াতেই সকাল সকাল ভোট দিয়েছিল ভোটাররা। এদিকে ভোট শুরুর আগে বিক্ষিপ্ত কিছু অশান্তির খবর এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার শহরের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে উত্তেজনা। সাধারণ ভোটারকে ভয় দেখানো এবং বাড়ি ভাঙচুর ও মারধরের অভিযোগ তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল। পাশাপাশি কোচবিহারের মাথাভাঙায় নির্বাচনের আগে এক সিআরপিএফ জওয়ানের রহস্যমৃত্যু কেন্দ্র করে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। জানা যায়, ওই জওয়ানের নাম নীলেশ কুমার নিলু, তার বাড়ি বিহারে। মাথাভাঙা বাইশগুরি হাই স্কুলে তিনি কিউআরটি টিমের কমান্ড্যান্ট। রাতে হঠাৎ তার নাক-মুখ দিয়ে রক্তপাত শুরু হলে হাসপাতালে নিয়ে এলে মৃত ঘোষণা করা হয়। পরে লাশ ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়। লোকসভা ভোটের পাশাপাশি গতকাল অরুণাচল প্রদেশ ও সিকিমে একটি মাত্র দফায় বিধানসভার ৯২ আসনে ভোট নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে অরুণাচল প্রদেশে ৬০ ও সিকিমে ৩২ আসন রয়েছে।

সর্বশেষ খবর