মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

যুদ্ধে নয়, জলবায়ু খাতে অর্থ ব্যয় করুন : প্রধানমন্ত্রী

ছয় দিনের সফরে কাল থাইল্যান্ড যাচ্ছেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

যুদ্ধে নয়, জলবায়ু খাতে অর্থ ব্যয় করুন : প্রধানমন্ত্রী

যুদ্ধে অর্থ ব্যয় না করে সেই টাকা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় খরচ করার জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গতকাল সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপশন প্ল্যান (ন্যাপ) এক্সপো-২০২৪’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান। চার দিনের এই অনুষ্ঠান চলবে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত।

ন্যাপ এক্সপোতে অংশগ্রহণের জন্য ১০৪টি দেশের ৩৮৩ জন ইউএনএফসিসিতে রেজিস্ট্রেশন করেছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা, জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা, এনজিওর প্রতিনিধিরা, স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষার্থীসহ ৫৫০ জন অংশগ্রহণ করবেন। আন্তর্জাতিক এই ফোরামে বিভিন্ন দেশ, সংস্থা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা ন্যাপ প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পারস্পরিক যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা বিনিময় করবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, যুদ্ধে অস্ত্র এবং অর্থ ব্যয় না করে সেই টাকা জলবায়ু পরিবর্তনে যদি ব্যয় করা হতো তাহলে বিশ্ব রক্ষা পেত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় ১৯৭২ সালেই বৈশ্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপন করেছিলেন। দেশের উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য তিনি ১৯৭৫ সালের ১ জুলাই ন্যাশনাল হারবেরিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন। সরকার বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই নিজস্ব সম্পদ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। তিনি বলেন, অভিযোজন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ২০০৯ সালে আমরা নিজস্ব অর্থায়নে ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড’ প্রতিষ্ঠা করেছি। এর আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ৯৬৯টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সামুদ্রিক বাঁধ, সাইক্লোন শেল্টার, উপকূলীয় বনায়ন ইত্যাদি কর্মসূচিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৫টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার তথ্য তিনি অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।

১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং গত বছরের ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র ক্ষয়ক্ষতির পার্থক্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭০ সালে প্রায় ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু মোখায় কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। এটি জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে বাংলাদেশের সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। তিনি আরও বলেন, গত দেড় দশকে পার্বত্য ও শাল বনাঞ্চলের প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার ৫৪৮ হেক্টর এলাকায় বৃক্ষরোপণসহ ৮৯ হাজার ৮৫৩ হেক্টর উপকূলীয় বন সৃজন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারসমূহের জন্য কক্সবাজার জেলায় আমরা বিশ্বের বৃহত্তম ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’ নির্মাণ করেছি। এ প্রকল্পের আওতায় ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করে ৪ হাজার ৪০৯টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আমরা জলবায়ু উদ্বাস্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভূমিহীন, গৃহহীন, সমাজের পিছিয়ে পড়া অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষকে জমিসহ ঘর প্রদান করেছি এবং তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা প্রায় ৪২ লাখ মানুষকে পুনর্বাসন করেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশের কম হলেও এর নেতিবাচক প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের মধ্যে ‘বাংলাদেশ অন্যতম’। অব্যাহত বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১২ থেকে ১৭ শতাংশ এ শতাব্দীর শেষ দিকে সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তিনি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে সীমিত রাখতে উন্নত বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করেছি যাতে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস পায়। এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন এবং গ্রামাঞ্চলের ৪৫ লাখের বেশি উন্নত চুলা বিতরণ করা হয়েছে। মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যানে অভিযোজন ও প্রশমন কার্যক্রমে স্থানীয় জনগণের স্বপ্রণোদিত অংশগ্রহণ, প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান ও সমাজের সবার অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা ২০২২-২০৫০ প্রণয়ন করেছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে এটি ইউএনএফসিসিতে দাখিল করা হয়েছে। এ পরিকল্পনায় আমরা ১১টি জলবায়ু ঝুঁকিমুক্ত এলাকায় ৮টি খাতে ১১৩টি অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রম চিহ্নিত করেছি। এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রায় ২৩০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন জানিয়ে এই অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা নিতে বিশ্বের ধনী দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) সভাপতি থাকাকালে অভিযোজন এবং প্রশমন কার্যক্রমে উন্নত দেশসমূহের প্রতিশ্রুত ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রতি বছর দেওয়ার বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছি। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সম্ভাব্য ক্ষতি হ্রাসে অভিযোজন ও প্রশমন উভয় ক্ষেত্রে উপযোগী কার্যক্রম গ্রহণ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ইউএনএফসিসির ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল থেকে অর্থপ্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে প্রথম দিনের ‘হাইলেভেল ট্রান্সফরমেশনাল ডায়ালগ : এ ট্রান্সফর্মড ন্যাপ ফর দ্য ফিউচার’ শীর্ষক অধিবেশনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, অভিযোজন শুধু স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য একটি চ্যালেঞ্জ নয় বরং এটি আমাদের সবার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। এ লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী সংহতি প্রয়োজন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ মাত্র শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ হলেও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ শিকারের অন্যতম দেশ বাংলাদেশ। বৈশ্বিক তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে জলবায়ু অভিযোজন কর্মসূচির খরচ বেড়ে যাবে।

অনুষ্ঠানে ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের নির্বাহী সেক্রেটারি সাইমন স্টিল, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ এবং ফিলিপাইন ক্লাইমেট চেঞ্জ কমিশন প্রেসিডেন্টের অফিসের পরিচালক রবার্ট ই এ বোর্জে প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

ছয় দিনের সফরে থাইল্যান্ড যাচ্ছেন : ছয় দিনের সফরে আগামীকাল বুধবার থাইল্যান্ড যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী স্রেথা তাভিসিনের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৪ এপ্রিল থেকে ২৯ এপ্রিল থাইল্যান্ডের ব্যাংককে সরকারি সফর করবেন। সফরে ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিকের (ইউএনএসক্যাপ) ৮০তম অধিবেশনে যোগ দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলে কয়েকজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা ও ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা অন্তর্ভুক্ত থাকবেন বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি, তিনটি সমঝোতা স্মারক ও একটি লেটার অব ইন্ট্যান্ট স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী ২৬ এপ্রিল থাইল্যান্ডের গভর্নমেন্ট হাউসে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। একই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সৌজন্যে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী আয়োজিত রাষ্ট্রীয় মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেবেন। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অফিশিয়াল পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা অব্যাহতিসংক্রান্ত চুক্তির পাশাপাশি জ্বালানি, পর্যটন ও শুল্কসংক্রান্ত পারস্পরিক সহযোগিতাবিষয়ক তিনটি সমঝোতা স্মারক এবং মুক্তবাণিজ্য চুক্তির আলোচনা শুরুর জন্য একটি লেটার অব ইন্ট্যান্ট স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাইল্যান্ডের রাজপ্রাসাদে রাজা মহা ভাজিরা-লংকর্ন ফ্রা ভাজিরা-ক্লাচাও-উহুয়া এবং রানি সুধিদা বজ্রসুধা-বিমলা-লক্ষণের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফরের মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য ‘মুক্তবাণিজ্য চুক্তি’র পর্যালোচনার পাশাপাশি অন্যান্য অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় বিশেষত বিনিয়োগ, পর্যটন, জ্বালানি, স্থল এবং সমুদ্র সংযোগ, উন্নয়ন প্রভৃতি খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আশা করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের অফিশিয়াল পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা অব্যাহতি দেওয়া হলে উভয় দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে যোগাযোগ সহজতর হবে এবং বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও প্রশিক্ষণে সরকারি কর্মকর্তারা সময়মতো যোগদান করতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে আসিয়ানের ‘সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার’ হিসেবে মর্যাদা লাভে বাংলাদেশের আবেদনের বিষয়ে আরও জোরালোভাবে অনুরোধ করা এবং রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন ও মিয়ানমারে চলমান সংঘাত নিরসনে থাইল্যান্ডসহ আসিয়ান সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে আরও বেশি সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানো হবে বলে জানা গেছে। ব্যাংককে জাতিসংঘ সম্মেলন কেন্দ্রে ২৫ এপ্রিল এশীয় প্রশান্ত অঞ্চলের জন্য জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইউএনএসক্যাপ) ৮০তম অধিবেশনে জাতিসংঘের এজেন্ডা ২০৩০ ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ বক্তব্য প্রদান করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। একই দিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইউএনএসক্যাপের নির্বাহী সচিব সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।

সর্বশেষ খবর