বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

তাপমাত্রায় বাড়ছে উৎকণ্ঠা

♦ হিটস্ট্রোক ডায়রিয়া সর্দি-কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত মানুষ ♦ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা চিন্তায় ♦ কর্মক্ষমতা কমায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি ♦ তাপপ্রবাহের বিস্তার হতে পারে

নিজস্ব প্রতিবেদক

তাপমাত্রায় বাড়ছে উৎকণ্ঠা

রাজধানীর আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে বেড়েছে শিশু রোগী -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশজুড়ে চলমান তীব্র তাপপ্রবাহে মানুষের উৎকণ্ঠা বাড়ছে। অতিরিক্ত গরমে মানুষজন একদিকে হাঁসফাঁস করছে, অন্যদিকে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সীরা ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশি ও জ্বরসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। জীবিকার তাগিদে ঘরের বাইরে বের হয়ে অনেকেই হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে।

নিম্নআয়ের শ্রমজীবী মানুষসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা তপ্ত রোদে পুড়ে অসুস্থ ও ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে আবহাওয়া অধিদফতর দেশজুড়ে দ্বিতীয় বারের মতো হিট অ্যালার্ট জারি করেছে। শিক্ষার্থীদের সুস্থতার কথা ভেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। তীব্র তাপে ফসলের মাঠে ধানসহ বিভিন্ন শাকসবজি এবং ফল চাষে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ক্ষতি হচ্ছে পোলট্রি ব্যবসায়ীদেরও। গরমে ক্লান্ত মানুষের কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতির ওপর।

দাবদাহের কারণে শিক্ষার্থীরা যাতে অসুস্থ হয়ে না পড়ে এ জন্য সরকার দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনির্ধারিত ছুটি ঘোষণা করেছে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। তবে আগামী মে মাসেও তাপমাত্রা বেশি থাকতে পারে সেক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে না বন্ধ থাকবে- এ নিয়ে দ্বিধায় আছে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলমান পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাসের কথা ভাবছে সরকার। শিক্ষামন্ত্রী এখন দেশের বাইরে রয়েছেন। তিনি ফিরে এলে বা তার নির্দেশনা পেলেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হতে পারে। অতিরিক্ত গরমের কারণে সব বয়সী মানুষ ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ঠান্ডা-গরমে অনেকেরই জ্বর ও সর্দি-কাশি হচ্ছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের বেশি ভুগতে দেখা যাচ্ছে। শ্যাওড়াপাড়ার ৬৫ বছরের বৃদ্ধা ফজিলাতুননেছার গত দুই দিন ধরে ডায়রিয়া ও বমি হচ্ছে। তিনি জানান, দাওয়াতে গিয়ে বিরিয়ানি খেয়ে বাসায় ফিরে এসেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এখন চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় স্যালাইন ও মসলাবিহীন খাবার খাচ্ছেন। এরই মধ্যে গরমে হাসপাতালগুলো হিটস্ট্রোকের রোগী বাড়তে পারে এই আশঙ্কায় পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।

অতিরিক্ত গরমে খেটে খাওয়া নিম্ন্নআয়ের শ্রমজীবী মানুষগুলোর কষ্ট সবচেয়ে বেশি। রিকশাচালক, হকার, বিভিন্ন পরিবহনশ্রমিক ও পোশাকশ্রমিকরা গরমে ঘেমে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও জীবিকার তাগিদে তারা বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। এ ছাড়া বিভিন্ন পেশাজীবী ও কোম্পানির মার্কেটিং ও সেলসে চাকরি করে এমন পেশাজীবীদের অবস্থাও বেহাল। আহমেদ সানি নামের এক ওষুধ রিপ্রেজেনটেটিভ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই গরমে আমাদের হাসপাতাল ও ফার্মেসিগুলোতে যেতে হচ্ছে। চাইলেও ছুটি নিতে পারছি না। রোদে মাথা ঘোরে, পিপাসা লাগে কিন্তু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ নেই।’ গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন পোশাকশ্রমিকরাও। অনেক কারখানার শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এতে কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ক্রেতার অর্ডার সময়মতো পূরণ করতে কারখানা মালিকরা হিশশিম খাচ্ছেন। গরমে বিপাকে পড়েছেন পোলট্রি ব্যবসায়ীরাও। প্রচণ্ড গরমে একসঙ্গে অনেক মুরগির মৃত্যুতে তারা লোকসানে পড়ছেন। চাঁদপুরের পোলট্রি ব্যবসায়ী কুদ্দুস মিয়া জানান, গরমের কারণে এক দিনে তার এক হাজারের বেশি মুরগি মারা গেছে। এতে তিনি বড় লোকসানে পড়েছেন। গরমের কারণে ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে বলে জানান কৃষকরা। বিশেষ করে এ মৌসুমে মাঠে থাকা বোরো ফসল দাবদাহের কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাটির আর্দ্রতা কমে যাওয়ায় বাড়তি সেচ দিতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। বগুড়ায় মরিচ, কচু, ভুট্টা, কলা, করলা, পটলসহ বিভিন্ন ফসল তীব্র দাবদাহের কারণে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ রকম দাবদাহ চলতে থাকলে কৃষকদের বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। শিবগঞ্জ উপজেলার আকন্দ পাড়ার কৃষক ময়নুল হাসান জানান, তিনি দেড় বিঘা জমিতে দেশি মাগুড়া জাতের মরিচ চাষ করেছেন। মরিচের গাছে ফুল আসতে শুরু করেছে। কিন্তু তীব্র দাবদাহে গাছ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এমনকি প্রখর রোদে ফুলগুলো লালছে বর্ণ ধারণ করে ঝরে পড়ছে। এ বছর মরিচ চাষে প্রতি বিঘায় ২০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। এ ছাড়াও গরমের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আম-লিচুর বাগানেও।

হিট স্ট্রোকে আরও তিনজনের মৃত্যু : কয়েক দিন ধরেই রাজধানীসহ সারা দেশে তীব্র তাপপ্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। গরমের মাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিট স্ট্রোকে মানুষের মৃত্যুও বাড়ছে। গতকালও রাজধানীসহ সারা দেশে আরও তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। জানা গেছে, মঙ্গলবার এক পুলিশ কনস্টেবলসহ রাজধানী ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায় নয়জনের মৃত্যু হয়। ২০ এপ্রিল থেকে গতকাল পর্যন্ত পাঁচ দিনে সারা দেশে হিট স্ট্রোকে মারা গেছেন ৩৬ জনেরও বেশি মানুষ। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক ওয়ারেছ তূর্য মারা গেছেন। তীব্র তাপপ্রবাহে হিট স্ট্রোকে তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করছেন স্বজনরা। ইশতিয়াক ওয়ারেছ তূর্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের ২০২তম ব্যাচের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে। গতকাল সকালে তার লাশ নিজ জেলায় নিয়ে যাওয়া হয়।

এদিকে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় বরগুনার তালতলীতে পুকুর খননের সময় হিট স্ট্রোকে নয়া মিয়া ফকির (৫০) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, খোট্টার চর গ্রামের হাসান মিয়ার বাড়িতে পুকুর খননের কাজ করতে যান নয়া মিয়া ফকির। তখন তিনি হিট স্ট্রোক করেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে হিট স্ট্রোকে নুর ইসলাম (৭৫) নামে অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। জানা গেছে, নুর ইসলাম উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা এবং স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। সকাল ১০টায় প্রচণ্ড গরমে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বাড়ির আঙিনায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। পরিবারের লোকজন টের পেয়ে প্রথমে মাথায় পানি দেন। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা ১১টায় তার মৃত্যু হয়।

সর্বশেষ খবর