সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

দাবদাহে সড়কে প্রয়োজন পলিমার মডিফাইড বিটুমিন

নিজস্ব প্রতিবেদক

দাবদাহে সড়কে প্রয়োজন পলিমার মডিফাইড বিটুমিন

তীব্র দাবদাহে দেশের অনেক জেলা সড়কের উপরিভাগের পিচ ৩৭ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গলে যাচ্ছে। কিন্তু এ তাপে বিটুমিন গলে যাওয়ার কথা নয়। ঢাকার বাইরের সড়কগুলোতে বিটুমিনের পরিবর্তে আলকাতরা ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এতে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে এবং মজবুত সড়ক তৈরিতে পলিমার মডিফাইড বিটুমিন (পিএমবি) ব্যবহারে জোর দিচ্ছেন প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞরা। 

চলতি মাসে রেকর্ড ২৫ দিনের বেশি তাপপ্রবাহ চলছে এবং দেশের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি ছিল। দাবদাহে সম্প্রতি যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও শরীয়তপুরের বেশ কিছু স্থানে সড়ক-মহাসড়কের উপরিভাগ গলে গেছে, যা সড়ক নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। জানা যায়, শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কের ভেদরগঞ্জ উপজেলার বালি বাড়ির মোড় থেকে নরসিংহপুর ফেরিঘাট পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানের বিটুমিন গলে গেছে। ১৭ কিলোমিটারের এ সড়কটির প্রায় ১৫টি স্থানে প্রচ- তাপপ্রবাহের কারণে বিটুমিন গলে সড়কটি ভিজে গেছে। ভেজা অংশ দিয়ে গাড়ি চালাতে গেলে টায়ারের সঙ্গে বিটুমিন লেগে যাচ্ছে। শুধু এ সড়কই নয় কালিয়াকৈর-ফুলবাড়িয়া আঞ্চলিক সড়কেরও বেশ কিছু জায়গায় বিটুমিন গলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

সাধারণত সড়কে ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়। এর গলনাঙ্ক ৪৮ থেকে ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ ৪৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় এ মানের বিটুমিন গলে যায়। আবার সরকারি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারির (ইআরএল) উৎপাদিত পিচের গলনাঙ্ক ৫২ থেকে ৫৮ ডিগ্রি। কিন্তু পলিমার মডিফাইড বিটুমিনের (পিএমবি) গলনাঙ্ক ৭০ ডিগ্রির বেশি। রাজধানীর বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প, এলেঙ্গা-রংপুর মহাসড়কে পিএমবি ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি রাজধানীর শৈল্পিক সড়কের পরিচিতি পাওয়া শেখ হাসিনা সরণিও (৩০০ ফুট সড়ক) বিটুমিনে তৈরি হয়েছে। কিন্তু এসব সড়কে বিটুমিন গলছে না।   বুয়েট এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সড়কে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে। সড়কের উপরিভাগের তাপমাত্রা আশপাশের পরিবেশের চেয়ে ১৫-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকে। কারণ, বিটুমিন কালো হওয়ার কারণে তা অনেক বেশি তাপ শোষণ করে এবং গাড়ির চাকার সঙ্গে ক্রমাগত ঘর্ষণের কারণেও তাপ উৎপন্ন হয়। এতে বিটুমিন গলে যায়, এটাকে ব্লিডিং বলে। কিন্তু বিষয় হলো সব জায়গার বিটুমিন ওঠেনি। তাই লাভের আশায় ঠিকাদাররা বিটুমিনে কোনো গরমিল করেছে কি না তা যাচাই করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। তাই ১০-১৫ বছর আগেই দেশের সড়কে পলিমার মডিফাইড বিটুমিন (পিএমবি) ব্যবহার শুরু করতে হতো। কারণ, এ বিটুমিন ৭০-৮৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। দেশে যে পলিমার মডিফাইড বিটুমিনের ব্যবহার নেই তা কিন্তু না। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বেশ কিছু সড়কে এ বিটুমিন ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এটাকে সর্বজনীন করতে হবে। সব সড়কেই এ বিটুমিন ব্যবহার করতে হবে। যে সড়কগুলো দাবদাহে গলে গেছে সেখানে মেরামতে এ বিটুমিন ব্যবহার করা উচিত। এ বিটুমিন ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিনের চেয়ে কিছুটা ব্যয়বহুল হলেও এটি দিয়ে নির্মিত সড়কের জীবনকাল বেশি। ফলে সেদিক থেকে খরচ কমে যায়।’

সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, সড়ক ঠিক করার জন্য অনেক সময় সড়কে সাময়িকভাবে বিটুমিনের পাতলা স্তর ব্যবহার করা হয়, তাই সম্ভবত সমস্যার সৃষ্টি করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কিছু প্রভাব তো আছেই, তবে আমরা নিশ্চিত নই যে এখানে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক কোনো প্রভাব আছে কি না। আমরা সেটি খতিয়ে দেখছি। তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক মেরামত ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক প্রশস্ত করতে পলিমার মডিফাইড বিটুমিন ব্যবহার শুরু হয়েছে।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ায় দেশের সড়কে পিএমবির বিটুমিন ব্যবহার করা প্রয়োজন। কিন্তু পিএমবির বড় সমস্যা হচ্ছে সময়। বেশি দিন মজুত অবস্থায় পড়ে থাকলেও এর গুণাগুণ নষ্ট হয়। তাই আমদানি করা নয়, দেশে উৎপাদিত পিএমবি ব্যবহার দরকার। যা উৎপাদনের পরপরই ব্যবহার করা যাবে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বে পদার্পণ করতে হলে টেকসই যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাই বাংলাদেশেও বিশেষ করে ভারী ও বেশি যানবাহন চলাচলকারী সড়ক-মহাসড়কে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের সড়কগুলোতে বর্তমানে ১৮ টন ধারণক্ষমতার যানবাহন চলাচলে বিধান আছে। কিন্তু চলছে প্রায় ৪০ টন ওজনের যানবাহন। এতে রাস্তা দ্রুত নষ্ট হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করলে এ সড়কেই ৫০ থেকে ৭০ টন পণ্যবোঝাই যানবাহন চলাচল করতে পারবে। একসঙ্গে বেশি পণ্য পরিবহন করতে পারলে পণ্য পরিবহনের গড় খরচও কমে আসবে। বিটুমিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত নিম্ন ও উচ্চ তাপমাত্রায় বিটুমিনের সংবেদনশীলতা কমে যাওয়ায় ১৯৮০ সাল থেকে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিনের ব্যবহার হয়ে আসছে। এটি মহাসড়কের উপরিভাগকে সব ধরনের আবহাওয়াজনিত ক্ষতি, ফাটল বা খানাখন্দ তৈরি হওয়া থেকে রক্ষা করে। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতায় ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ২০২২-২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর মধ্যে ৩ হাজার ৯৯১ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ৪ হাজার ৮৯৭ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ১৩ হাজার ৫৫৮ কিলোমিটার জেলা সড়ক।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর