বুধবার, ১ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

ভালো নেই শ্রমজীবীরা

♦ সমস্যা আক্রান্ত নারী শ্রমিক ♦ কৃষি খাতে নেই মজুরি নির্ধারণ ♦ খাদ্য-বাসস্থানের সংকট ♦ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে বেড়েছে কষ্ট

জিন্নাতুন নূর ও হাসান ইমন

ভালো নেই শ্রমজীবীরা

ছবি : রোহেত রাজীব

ভালো নেই দেশের শ্রমজীবীরা। নানান সংকটে তাদের জীবন। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান সব ক্ষেত্রেই সংকটে ভুগছে। এর মধ্যে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি শ্রমজীবীদের জীবন আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। নারী শ্রমজীবীদের সংকট আরও বহুমুখী। তাদের কর্মজীবন নানা সমস্যায় আক্রান্ত এবং বৈষম্যের মধ্য দিয়ে চলেছে। আর দেশে সবচেয়ে বড় শ্রম খাত কৃষি হলেও এখানে নেই কোনো আলাদা নির্ধারিত মজুরি। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই ‘শ্রমিক-মালিক গড়ব দেশ, স্মার্ট হবে বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশে পালিত হবে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার দিন-মহান মে দিবস।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট শ্রমজীবীর সংখ্যা ৭ কোটি ১০ লাখ। পুরুষ ৪ কোটি ৬৪ লাখ, নারী ২ কোটি ৪৬ লাখ। দেশে কর্মরত বিশালসংখ্যক শ্রমজীবীর উল্লেখযোগ্য অংশ নারী হলেও এখনো সরকার নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। কাজ করতে গিয়ে নারী শ্রমিকরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। প্রায়ই তাদের বেতন বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। আছে যৌন হয়রানির আশঙ্কাও। ফলে কলকারখানাসহ বিভিন্ন খাতে নারী শ্রমিকরা তার পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে বেশি খেটেও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। আবার আইনে নারী শ্রমিকদের যেসব সুযোগসুবিধা পাওয়ার কথা তা মালিকের অনাগ্রহ ও পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। শ্রম আইনে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির কথা বলা থাকলেও বেশির ভাগ নারী শ্রমিক তা পান না। কারখানাগুলোয় বড়জোর চার মাসের ছুটি কাটানোর সুযোগ মেলে। আবার কিছু কারখানায় নারী শ্রমিকদের চাকরিও স্থায়ী করতে চান না কর্তৃপক্ষ। দেখা যায়, মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটানোর পর সেই নারী শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়। আবার মাঠের বা দিনমজুরের কাজে একজন পুরুষ শ্রমিক যেখানে দিনে ৪০০ টাকা পান সেখানে নারী পান ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। পুরুষ কাজের মাঝে বিশ্রামের সুযোগ পেলেও নারী তেমন সুযোগ সাধারণত পান না। ইটভাটায় যেখানে পুরুষ দিনে মজুরি পান ৫০০ টাকা, সেখানে নারী পান ৩০০ টাকা। পুরুষের সমান মজুরি চাইলে নারী শ্রমিকদের কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়াসহ নানা রকম হয়রানি করা হয়। শ্রমিক নেতারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলছেন, কলকারখানায় কর্মরত নারী ও পুরুষ শ্রমিকের সমমজুরি দেওয়া হয় না। নারীরা আট ঘণ্টার জায়গায় বারো ঘণ্টা শ্রম দিচ্ছেন। তার পরও পুরুষের সমান মজুরি পাচ্ছেন না। অভিযোগ আছে-পোশাক খাত ছাড়া নিয়মিত ভিত্তিতে অন্য খাতগুলোয় শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ হচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর বেতন বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ। এর ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ বাজারে শ্রমিকদের জীবনধারণ হয়ে পড়েছে কষ্টকর। অবশ্য পোশাক খাতের নির্ধারিত মজুরিতেও জীবনধারণ কঠিন। বর্তমানে দেশে তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকের মধ্যে ৩ লাখের ওপর রয়েছেন ন্যূনতম মজুরিভুক্ত। যাদের বেতন ১৩ হাজার টাকার নিচে। এদের অধিকাংশেরই প্রতিদিন এক বেলা অনাহারে কাটাতে হয়। আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের সেই কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে পোশাক শিল্পে প্রায় ৪২ লাখ শ্রমিক। এর বেশির ভাগই সীমিত আয়ের কারণে পুষ্টিকর খাবারবঞ্চিত। খাদ্যে আমিষ বা পুষ্টি না থাকায় শারীরিক কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এতে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ শ্রমিকরা। বিবিএসের তথ্যে, দেশে কৃষিশ্রমিক আছেন ৭৭ লাখ। বিবিএসের কৃষি ও পল্লী পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে বলা হয়-দেশে একজন কৃষিশ্রমিক গড়ে দৈনিক ৩৮৬ টাকা টাকা মজুরি পান। আবার তারা প্রতিদিন যে কাজ পান এমনও না। দেশের সব জেলার পল্লী এলাকার ৫৭ হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর জরিপ চালিয়ে এমন তথ্য পাওয়া যায়। এ টাকায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুই বেলা শাকসবজি দিয়ে খেয়েপরে থাকাও এখন কষ্টের। নিম্নতম মজুরি বোর্ড কর্তৃপক্ষও কৃষিশ্রমিকদের বোর্ডের আওতায় আনবেন না। ফলে বরাবরের মতোই বাজারের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে কৃষি খাতে মজুরি নির্ধারিত হবে। নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গৃহকর্মীদের জন্য মজুরি বোর্ড গঠন করার জন্য মন্ত্রণালয়ে এরই মধ্যে আমরা চিঠি দিয়েছি। তবে কৃষি খাত মজুরি বোর্ডের আওতায় আনা হবে না।’ শ্রমিকরা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতায় সবচেয়ে বেশি কষ্টের মধ্যে পড়েছেন। তাঁদের সরকার নির্ধারিত যে ন্যূনতম মজুরি দেওয়া হয়, তা এ বাজারে জীবনধারণের জন্য বেশ অপ্রতুল। কারণ শ্রমিকদের মজুরি যে হারে বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম। জানা যায়, শ্রমিকদের আয়ের অর্ধেকই চলে যাচ্ছে ঘর ভাড়ার পেছনে। নিম্নবিত্ত শ্রমিকরা রাজধানীর বিভিন্ন বস্তি এলাকায় এক রুমের একেকটি ঘরে কোনোরকমে গাদাগাদি করে পরিবারের পাঁচ-ছয় জন সদস্য নিয়ে থাকছেন। এর ফলে তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা যেমন থাকছে না একই সঙ্গে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিও হুমকিতে পড়ছে। আবার নিশ্নবিত্তদের কেউ কেউ ঘর ভাড়ার অতিরিক্ত খরচ বহন করতে না পেরে পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। মিরপুর দুয়ারিপাড়া বস্তিতে স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে এক রুমের একটি ঘরে ভাড়া থাকেন গৃহকর্মী রাশিদা আক্তার। সন্তানদের চৌকিতে থাকতে দিয়ে রাশিদা ও তার স্বামী মেঝেতে ঘুমান। এই গৃহকর্মী জানান, স্বামী আগে মাছ বিক্রি করতেন, এখন অসুস্থ। তার মাসিক আয় ৮ হাজার টাকা। ঘর ভাড়া দেন ৪ হাজার ৪০০ টাকা। অর্থাৎ আয়ের অর্ধেকের বেশি তার ঘর ভাড়ায় চলে যায়। এরপর সংসার চালান ধারদেনা করে। এ ছাড়া গৃহশ্রমিকদের এখনো শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাই তারা এখনো শ্রমিক হিসেবে আইনি সুরক্ষা পাচ্ছেন না। যদিও সরকার গৃহশ্রমিকদের সুরক্ষায় ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫’ প্রণয়ন করেছে। তবে এ নীতির বাস্তবায়ন নেই। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘গৃহশ্রমিক নিবন্ধন না থাকায় তাদের অধিকার আইন দ্বারা স্বীকৃত নয়। যদি আইনের স্বীকৃতি থাকত, নিবন্ধন হতো, মাঝেমধ্যে সিটি করপোরেশন বা শ্রম অধিদফতর থেকে লোকজন একটি মহল্লার দু-তিনটি বাড়িতে গিয়ে গৃহকর্মী শিশু বা নারীদের সাক্ষাৎকার নিত তাহলে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটত না।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর