শনিবার, ৪ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

ট্রেন কেন থাকে না লাইনে

বিশেষ প্রতিনিধি

গত দেড় দশকে লাখো কোটি টাকার বিপুল বিনিয়োগ নিয়েও লাইনে থাকছে না ট্রেন। লাইনচ্যুতির ঘটনাই রেলপথের বড় বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে নিরাপদ রেলযাত্রা এখন আতঙ্কের বাহনে পরিণত হয়েছে। গত এক যুগে রেলপথের উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে রেলের ৩৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে, যার সম্ভাব্য ব্যয় প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। আকাশছোঁয়া বিনিয়োগের পরও গত এক যুগে রেলের লোকসান প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচের পরও ট্রেনের গতি তো বাড়েইনি, উল্টো কমেছে। ধীরগতির এ রেলযাত্রায়ও প্রায়ই লাইন ছেড়ে থমকে যায় রেল। হঠাৎ পড়ে দুর্ঘটনায়, মুখোমুখি সংঘর্ষে। ভরসার রেল এখন ভয়ের বাহনে পরিণত হয়েছে। এখনো দেশের ৬৩ শতাংশ রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ আর ৭০ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়েই যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে পরিচালন অব্যবস্থাপনা।

চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত গত দুই বছরে সারা দেশে রেলপথে মোট ১৭০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে ৪৯ জনের। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে এমপি এম আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য জানান রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম। গতকালও গাজীপুরের জয়দেবপুরে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে উভয় ট্রেনের নয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। ১৭ মার্চ কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে হাসানপুর রেলস্টেশনের কাছে চট্টগ্রাম থেকে জামালপুরগামী বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের নয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। শুধু এ দুটি দুর্ঘটনাই নয়, রেলওয়ের সর্বশেষ প্রকাশিত ২০২০-২১ অর্থবছরের দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওই বছর মোট ১১১টি ট্রেন দুর্ঘটনার মধ্যে ৯২টি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। ট্রেন দুর্ঘটনার ৮৩ শতাংশই লাইনচ্যুত হওয়ার কারণে হচ্ছে। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮০টি দুর্ঘটনার মধ্যে ৭২টিই ঘটেছে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে। শতাংশের হিসাবে এটা ৯০ শতাংশ। রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে দুর্ঘটনা বেড়েছে ৩১টি। একই সঙ্গে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে ২০টি। রেলওয়ের তথ্য বলছে, ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ, বগি লাইনচ্যুত হওয়া, ভুল সিগন্যাল, বিয়ারিং প্লেট খুলে যাওয়া, রেললাইন বেঁকে যাওয়াসহ নানা কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে রেলপথে। এসব দুর্ঘটনায় আহতের পাশাপাশি প্রাণহানিও ঘটছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন, ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইন, রেল ট্র্যাকে পাথর না থাকা, সিগন্যালজনিত ভুলসহ নানা কারণে রেলে দুর্ঘটনা ঘটছে। অতীতের চেয়ে বর্তমানে বেড়ে গেছে রেল দুর্ঘটনা। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, গত পাঁচ বছরে রেলের দুর্ঘটনা অনেক কমে এসেছে। গত ১৭ মার্চ কুমিল্লার গুণবতী-হাসানপুর সেকশনে বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়ে। সেখানে ২০৮ নম্বর ব্রিজের বেয়ারিং প্লেট না থাকলেও ট্রেনটি চলছিল ৭০ থেকে ৭৫ কিলোমিটার গতিতে। ব্রিজে ডায়নামিক ইমপ্যাক্ট লোড ফিটিংস ও বিয়ারিং প্লেট না থাকায় সেতুটি লোড বহন করতে পারেনি বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের। এ রেল দুর্ঘটনার কারণে শিডিউল বাতিল হয়েছিল অন্তত ১৫টি ট্রেনের। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দুষ্কৃতকারীরা ব্রিজের বিয়ারিং প্লেট খুলে ফেলেছিল। আর তদন্ত কমিটির সুপারিশে বলা হয়-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রেলের দুর্ঘটনা রোধে আরও তৎপর হতে হবে, যাতে কোনো দুষ্কৃতকারী রেলের ক্ষতি করতে না পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রেল দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দুর্বৃত্ত কর্তৃক অপরাধ সংঘটনের কথা বলা হয়। অথচ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভাঙাচোরা দীর্ঘদিনের রেললাইন, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন, ত্রুটিপূর্ণ রেললাইন ব্রিজসহ নানা কারণে ঘটছে রেল দুর্ঘটনা। রেলপথ পরিদর্শন অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশের ৬৩ শতাংশ রেললাইন বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আর ৭০ শতাংশ রেলসেতু মেরামত করা প্রয়োজন। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে ব্যবহৃত রেলের অনেক ইঞ্জিন মেয়াদোত্তীর্ণ। এসব মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়েই পরিচালনা করা হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহনকারী এসব ট্রেন। বাংলাদেশ রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি রেল দুর্ঘটনার কারণ বিভিন্ন। প্রতি দুর্ঘটনার কারণ খুঁঁজতে করা হয় তদন্ত কমিটি। এ তদন্ত কমিটি দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করে থাকে। এদিকে রেলের বিভিন্ন দুর্ঘটনা প্রতিরোধ, জাতীয় নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি রক্ষায় সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চিঠি পাঠিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। মানবাধিকার কমিশনের চিঠিতে ২২ দফা সুপারিশ করা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে : রেলওয়ে পুলিশ, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে মোতায়েন করে রেলের নিরাপত্তা জোরদার করা; ট্রেনের অভ্যন্তরে ও প্রতিটি স্টেশনে সিসি ক্যামেরা স্থাপন; রেলে নাশকতার তদন্ত গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে করে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করা; রেলের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থার পাশাপাশি জিপিএসের সমন্বয় করা ইত্যাদি। রেলওয়ের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯ সাল থেকে ১২ বছরে রেললাইনে ২ হাজার ৬০১টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ট্রেনের চলার পথে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার দুর্ঘটনা ২৫৮টি। এসব দুর্ঘটনায় ৩৪৩ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ট্রেনের যাত্রী ৩২ জন, রেলের লোক ৪৩ জন। অন্য ২৬৮ জন ট্রেনের আরোহী নন। অর্থাৎ দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া অন্তত সাড়ে তিন গুণ মানুষ ট্রেনের আরোহী নন। ট্রেন দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং। রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে রেলক্রসিং আছে ২ হাজার ৫৪১টি। এসব ক্রসিংয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশে কোনো গেট ও গেটম্যান নেই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. শামসুল হক বলেন, এ লেভেল ক্রসিংয়ের বেশির ভাগই অনুমোদন ছাড়া এবং স্থানীয় সরকার বা মিউনিসিপ্যালিটি জনগণকে সন্তুষ্ট করার জন্য অবৈধভাবে তৈরি করেছে। তিনি বলেন, লেভেল ক্রসিং কিন্তু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটা জায়গা। যদি অবৈধভাবে সেটার সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং এটার যদি চেক না থাকে ঝুঁকিপূর্ণ তো হবেই এবং সেভাবেই কিন্তু লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনাগুলো বাড়ছে। ড. শামসুল হক বলেন, ট্রেন একটা আর্টিকুলেটেড বা জোড়া লাগানো গাড়ি। এটিতে হঠাৎ ব্রেক করা যায় না। তাহলে যাত্রীরা বড় ঝুঁকিতে পড়ে। এ কারণেই ট্রেনের নীতিমালায় বলা আছে-রেল ট্র্যাকের ১০ ফুটের মধ্যে সব সময় ১৪৪ ধারা জারি থাকবে অলিখিতভাবে। কেউ তার আশপাশে আসতে পারবে না। তবে বাস্তবে এর উল্টোটা দেখা যায়। সবাই রেলের জমি নিজের মনে করে অসংগতিপূর্ণ হাটবাজার, বসতি বানিয়ে রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। দুর্ঘটনা রোধে এসব অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে এবং সেগুলো উঠিয়ে দেওয়ার পর আবার যাতে বসতে না পারে তার জন্য সারা বছর তত্ত্বাবধান করতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রেলক্রসিংয়ের দুর্ঘটনাকে রেলওয়ে নিজেদের দুর্ঘটনা বলেই মনে করে না। রেলওয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, রেলক্রসিংয়ে যেসব দুর্ঘটনা সেগুলো রেলের দুর্ঘটনা নয়। অন্যরা এসে যদি রেলওয়ের জায়গায় ‘অবস্ট্রাকশন’ তৈরি করে সে কারণে দুর্ঘটনা হলে সেটা রেলের কিছু না। বর্তমানে দেশের ৪৩ জেলা রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত। রেলের কার্য ব্যবস্থাপনা পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে বিভক্ত। সারা দেশে এখন রেলপথ আছে ৩ হাজার ৯৩ কিলোমিটার। আর রেললাইন আছে ৪ হাজার ৪৩৮ কিলোমিটার। ৪৩ জেলার ৩৯টিতেই রেললাইনে সমস্যা রয়েছে। রেলপথের মান নষ্ট হওয়া, লাইনে পর্যাপ্ত পাথর না থাকা, মাটি সরে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে দেশের প্রায় অর্ধেক রেললাইন ঝুঁকিতে। সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের করা এক সমীক্ষায় এ চিত্র উঠে এসেছে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি বলছে, দেশে রেল দুর্ঘটনার কারণ দুর্বল ইঞ্জিন ও সংস্কারবিহীন নড়বড়ে রেলপথ। লোকোমোটিভ ইঞ্জিন যেগুলো আমদানি করা হয়েছে এগুলো আসলে নিম্নমানের এবং বেশ দুর্বল। দক্ষ জনবল সংকট রেলওয়ের বড় সমস্যা এখন। ১৯৮৬ সাল থেকে রেলওয়েতে নিয়োগ একেবারে বন্ধ ছিল। এর আগে বিএনপি সরকারের সময় রেলওয়ে থেকে ১০ হাজার দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক কর্মসূচির মাধ্যমে বিদায় করা হয়েছিল। ফলে ট্রেনের চালকসহ লোকবলের সংকট এখনো রয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে রেলওয়ে নতুন করে বিপুলসংখ্যক জনবল নিয়োগ দিতে শুরু করেছে। তাদের দক্ষ হয়ে উঠতে আরও সময়ের প্রয়োজন। ড. শামসুল হক বলেন, বর্তমানে ট্রেনের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু দক্ষ লোকবল তৈরি হয়নি। অভিজ্ঞ লোকোমাস্টার বা ট্রেনচালক যেমন দরকার, তেমন ট্রেনের শিফট বা শিডিউল যারা ব্যবস্থাপনা করেন সেই স্টেশন মাস্টারও দরকার। আর এ দায়িত্ব পালনে অনেক বেশি দক্ষতা ও ধৈর্য দরকার হয়। স্টেশন মাস্টারদের যে ধরনের দায়িত্বশীল হওয়ার কথা সেখানে গাফিলতির কারণেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করেন তিনি। রেলপথে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির কথা স্বীকার করে না বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রেলের দুর্ঘটনা ক্রমেই কমে আসছে। রেলের কিছু দুর্ঘটনা হয় ম্যানুয়াল আর কিছু মেকানিক্যাল ফল্টের কারণে। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, সারা দিনে দেশে ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রেন পরিচালনা করা হয়। এতসংখ্যক ট্রেন পরিচালনায় কিছু সমস্যা হয়েই থাকে। লোকবল সংকট, দক্ষতার অভাবসহ নানা কারণেও ঘটছে দুর্ঘটনা। মহাপরিচালক বলেন, ময়মনসিংহ থেকে মোহনগঞ্জ রুটে মাসে প্রায় ৬০০ ট্রেন পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে একটি-দুটি হয়তো দুর্ঘটনায় পড়ে। এটি স্বাভাবিক বলে মনে করি। এ ছাড়া পুরনো বগি, পুরনো ইঞ্জিনের কারণে রেলের ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ঘটনাও ঘটে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর