শনিবার, ৪ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

মোবাইল চোরের টার্গেটে জানাজা ও জুমার নামাজ

আলী আজম

জানাজা ও জুমার নামাজ ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন চোর চক্রের সদস্যরা। এরা রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদে জুমার নামাজের জন্য ওত পেতে থাকে। নামাজিরা মসজিদে প্রবেশ বা বাহির হতে গেলে ভিড়ের সময় চক্রের সদস্যরা চোখের পলকে মোবাইল ফোন হাতিয়ে নেয়। এ ছাড়া কেউ মারা গেলে চক্রের সদস্যরা সে খবর ফেসবুকের মাধ্যমে সংগ্রহ করে। পরে মৃত ব্যক্তির জানাজায় গিয়ে চক্রের সদস্যরা মোবাইল ফোন চুরি করে লাপাত্তা হয়ে যায়। ফোন চুরির সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা হাত বদল হয়ে যায়। চুরি করে প্রথমেই চক্রের সদস্যরা মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয়। এরপর সিম ফেলে দিয়ে মোবাইল ফোনটি ফ্ল্যাশ দেয়। দামি ফোন হলে ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি (আইএমইআই) নম্বর পরিবর্তন করে ফেলে। এরপর মোবাইল ফোনগুলো বিভিন্ন দামে বাজারে বিক্রি করে দেয়। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই চক্রের সদস্যরা অনলাইনের মাধ্যমে ঢাকা ও এর আশপাশে কোনো জানাজা আছে কি না তা খুঁজতে থাকে। কোনো জানাজার সন্ধান পেলে সেখানে কেমন মানুষের সমাগম হতে পারে তারা এ বিষয়ে খোঁজখবর নিতে থাকে। এ কাজের সাংকেতিক নাম ‘বডিকাজ’। এটি বলতে তারা বুঝায় লাশের কাজ, মানে জানাজার কাজ। জানাজার স্থান নির্ধারণ হওয়ার পর তারা সেখানে পায়জামা, পাঞ্জাবি ও টুপি পরে যায়। সেখানে গিয়ে তারা গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রতিটি গ্রুপে তিনজন করে সদস্য থাকে। এই গ্রুপের সদস্যরা জানাজার ভিড়ের মধ্যে কৌশলে একজনের পকেটে থেকে মোবাইল চুরি করে গ্রুপের দ্বিতীয় সদস্যকে দেয়। দ্বিতীয় সদস্য মোবাইলটি আবার তৃতীয় আরেকজনকে দেয়। মোবাইল হাতে পাওয়ার পর তৃতীয় ব্যক্তি জানাজার স্থান ছেড়ে চলে যায়। পকেট থেকে মোবাইলটি যে চুরি করে তাকে বলা হয় ‘মহাজন’। জানাজা ছাড়াও চক্রটির টার্গেটে থাকত শুক্রবারের জুমার নামাজ। শুক্রবার যেসব মসজিদে বেশি মানুষ জুমার নামাজ আদায় করতে আসেন, সেসব মসজিদে চক্রটির সদস্যরা তিনজনের গ্রুপ করে অবস্থান নিত। জুমার নামাজের কাতারে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে একই কায়দায় মোবাইল চুরি করে নিয়ে যায় তারা। মসজিদের এই চুরিকে তারা মসজিদ কাম বলে থাকে। জুমার নামাজকে কেন্দ্র করে চক্রটির সব থেকে বেশি গ্রুপ সক্রিয় থাকে বায়তুল মোকাররম মসজিদে। সম্প্রতি রমনা মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে মোবাইল ফোন খোয়ান সরকারি এক কর্মকর্তা। এ বিষয়ে রমনা থানায় একটি অভিযোগ করা হয়। তদন্ত নামে এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। চোরকে ধরতে সিসিটিভি ফুটেজ, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হয়। পাশাপাশি অ্যানালগ পদ্ধতিতেও তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হয়। চোরকে শনাক্ত ও মোবাইল ফোন উদ্ধারে ঢাকা মহানগরের চানখাঁরপুল, গুলিস্তান, জুরাইন বিক্রমপুর প্লাজা ও বুড়িগঙ্গা সেতু মার্কেট, যমুনা ফিউচার পার্কসহ বিভিন্ন এলাকায় টানা ছয় দিন অভিযান চালানো হয়। পরে সরকারি কর্মকর্তার হারানো মোবাইল ফোনসহ নয়জনকে গ্রেফতার করে এটিইউ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য পেয়ে চমকে যান এটিইউর সদস্যরা। চক্রটি পায়জামা, পাঞ্জাবি ও টুপি পরে জানাজা ও জুমার নামাজ থেকে মোবাইল ফোন চুরি করত।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন- মো. বাহাউদ্দিন হোসেন মিজি ওরফে বাহার, রমজান আলী, মো. হামিম আহমেদ ওরফে হামিম, আতিকুল ইসলাম, পারভেজ হাসান, মাসুদুর রহমান ওরফে মাসুদ, সাইফুল ইসলাম, ফয়সাল আহমেদ রনি ও মিল্লাত হোসেন। এ সময় তাদের কাছ থেকে তিনটি ল্যাপটপ, একটি মনিটর, সাতটি মোবাইল, কম্পিউটার ও ল্যাপটপ সামগ্রী এবং মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তনের কাজে ব্যবহৃত ১৬টি ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোর বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা, ওয়াজ মাহফিল এবং জানাজাসহ জনসমাগমস্থল থেকে মোবাইল ফোন চুরি করে। এরপর চোরাই মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তন করে কেনাবেচা করে। চোরাই মোবাইল গ্রুপগুলো থেকে মোবাইল সংগ্রহ করত চক্রের সদস্য বাহার। তার একজন মোটরসাইকেল চালক আছে। যে বাহারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গ্রুপগুলো থেকে মোবাইল সংগ্রহ করে। বাহার পরে মোবাইলগুলো গ্রেফতার মাসুদের কাছে পাঠিয়ে দিত। মাসুদের কাজ হচ্ছে চোরাই মোবাইলগুলো নির্দিষ্ট দোকানে পৌঁছে দেওয়া। তদন্তে তিনটি দোকানের নাম পাওয়া গেছে। জুরাইনের বিক্রমপুর প্লাজার এসআই টেলিকম, যার মালিক গ্রেফতার সাইফুল; জুরাইনের সেতু মার্কেটের ফয়সাল টেলিকম, যার মালিক গ্রেফতার ফয়সাল এবং যমুনা ফিউচার পার্কের চতুর্থ তলার একটি দোকান, যার মালিক গ্রেফতার মিল্লাত। এ দোকানগুলোতে চলত টেকনিক্যাল ও মোবাইল বিক্রির কাজ। অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া এটিইউর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আখিউল ইসলাম বলেন, মোবাইল ফোন চুরির এই চক্রটির সন্ধান পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। চক্রটি জানাজা ও জুমার নামাজকেন্দ্রিক তৎপর ছিল। প্রযুক্তিনির্ভর তদন্ত ও অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে টানা ছয় দিন অভিযান চালিয়ে এই চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। প্রথম ধাপে মোবাইলটি যে চুরি করে তাকে টানা পার্টির সদস্য বা কামলা বলে। এই কামলা ফোনটি চুরির সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি হাত বদল হয়। তারা দ্রুত ফোনটি বন্ধ এবং সিমটি ফেলে দেয়। দ্বিতীয় ধাপে ফোনটি ওস্তাদের কাছে দেওয়া হয়। সে ফোনটিতে ফ্লাশ দিয়ে দেয়। তৃতীয় ধাপে ফোনটি কিনে নেন আরেকটি চক্র। এরপর এই চক্রের সদস্যরা ফোনের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনের জন্য আরেক পার্টির কাছে দিয়ে দেন। তারা আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে সাধারণ ফোনের মতোই চুরি করা মোবাইল ফোনগুলো বাজারে বিক্রি করে দিত।

সর্বশেষ খবর