শুক্রবার, ১০ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

যেভাবে খুন হন জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী

বিশেষ প্রতিনিধি

রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানী জামে মসজিদের পাশের আবেদীন টাওয়ারের আট তলার সুপার ট্রাম্পস ক্লাবে চলছিল ডিসকো পার্টি। আবেদীন টাওয়ারের নিচে হঠাৎ গোলাগুলি। ভবনের সিঁড়ির কলাপসিবল গেটের সামনে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকেন তিনজন। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল চারপাশ। এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা বনানী। আট তলার পার্টিতেও শুরু হয় হুলস্থুল। পার্টিতে আগত অসংখ্য নারী-পুরুষ প্রাণভয়ে ছুটাছুটি শুরু করে। তারা পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা একজনের দেহ যখন ঘোরানো হয় তখন পরিচিত মুখটি দেখে অনেকেই আঁতকে ওঠেন। অনেকেরই চেনা এই মুখ। তিনি ছিলেন সেই সময়ের বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক সোহেল চৌধুরী। গুলিবিদ্ধ তিনজনের মধ্যে দুজন প্রাণে রক্ষা পেলেও ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছিলেন সোহেল চৌধুরী। ঘটনা ঘটিয়েই সেই রাতে গুলি করতে করতে অস্ত্রধারীরা পালিয়েছিল। তবে অস্ত্রসহ ধরা পড়েছিল একজন। তিনি হলেন আদনান সিদ্দিকী। ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যরাতের ঘটনা এটি। তৎকালীন সময়ে এই ঘটনাটিকে বলা হতো ‘ব্যয়বহুল খুন’। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ঢাকার গুলশান-বনানীতে জেঁকে বসেছিল ‘পার্টি কালচার’। বনানীর আবেদীন টাওয়ারের অষ্টম তলায় ট্রাম্পস ক্লাব তখন ছিল বেশ আলোচিত। শিল্পপতি, রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি সেখানে বিনোদন জগতের অনেকের মেলা বসত। চমক দিতে হাজির করা হতো বলিউডের নায়ক-নায়িকাদেরও।

ক্লাবের ঠিক পাশেই ছিল বনানী জামে মসজিদ। তার কাছেই একটি আবাসিক ভবনে থাকতেন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী। বাড়ির কাছে ট্রাম্পস ক্লাবের সামনেই ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর ভোররাতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল তাকে।

এই হত্যা মামলার তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, মধ্যরাতে ট্রাম্পস ক্লাবে গান-বাজনা বন্ধ করতে বনানী মসজিদ কমিটির কয়েকজনকে নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন সোহেল চৌধুরী। আর সেই কারণেই তাকে খুন হতে হয়েছিল।

হত্যাকান্ডের ২৫ বছর পর গতকাল ঢাকার আদালতের দেওয়া রায়ে তিনজনকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। তাদের একজন বিতর্কিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই, আরেকজন ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম, অন্যজন হলেন সেদিন হত্যাকান্ড ঘটিয়ে পালানোর সময় হাতেনাতে ধরা পড়া আদনান সিদ্দিকী। হত্যাকান্ডের পর আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করলেও বেশিদিন কারাগারে রাখতে পারেনি। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি আর দেশেই নেই।

এ হত্যাকান্ডে ভাড়াটে খুনি ব্যবহার হয়েছিল বলে গোয়েন্দাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে। খুনি হিসেবে সানজিদুল ইমন, লেদার লিটন, কিলার আব্বাস, মামুনসহ অনেকের নাম এলেও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সাক্ষী জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়, যার ছাপ রায়েও পড়ে।

চলচ্চিত্র জগতে আলোচিত প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে ট্রাম্পস ক্লাবে সোহেল চৌধুরীর একবার তর্কাতর্কি হয়েছিল বলে আদালতে জানিয়েছিলেন ক্লাবটির তৎকালীন ব্যবস্থাপক এনামুল হাফিজ খান। সেই ঘটনাটি ছিল খুনের আরও আগের। তিনি বলেছিলেন, তার সামনেই সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের কথা কাটাকাটি হলে তিনি তখন সোহেল চৌধুরীকে ক্লাব থেকে বের করে দিয়েছিলেন।

তার কিছুদিন পর ঘটনার রাতে সোহেল চৌধুরী দুই দফায় ট্রাম্পস ক্লাবে গিয়েছিলেন। প্রথমবার রাত ৯টার দিকে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেয়ে ফিরে আসেন। পরে রাত আড়াইটার দিকে পুনরায় গিয়ে ক্লাবের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। তখন আহত হন সোহেল চৌধুরীর বন্ধু আবুল কালাম আজাদ, ট্রাম্পস ক্লাবের কর্মচারী নিরব ও দাইয়ান। ঘটনার পরপরই স্থানীয়রা আদনান সিদ্দিকীকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছিল।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, ঘটনার রাতে সোহেল চৌধুরী বাসা থেকে প্রথমে বের হন আনুমানিক ৯টায়। তখন তার সঙ্গে ছিলেন শহীদ, আবুল কালাম আজাদ, হেলাল ও হাফিজ নামের চার বন্ধু। মধ্যরাতে তারা বাসায় ফিরে এসেছিলেন। ক্লাবে পার্টি হচ্ছে, এমন খবরে আবার বের হন।

সোহেল চৌধুরীর বাসা থেকে ট্রাম্পস ক্লাবের দূরত্ব ১০০ গজেরও কম। রাত আড়াইটার দিকে তারা পুনরায় ট্রাম্পস ক্লাবে যান। ক্লাবের নিচ তলার কলাপসিবল গেটের কাছে দুই যুবক তাদের আটকে দিলে শুরু হয় তর্কাতর্কি। তখন এক যুবক রিভলবার বের করে আবুল কালামকে প্রথমে গুলি করেন। এরপর সোহেল চৌধুরীর বুকে গুলি করে পালিয়ে যায়। পরে জানা যায়, সোহেল চৌধুরীকে হত্যা করে পাঁচ/ছয়জন প্রাইভেট কারে পালিয়ে যায়। আদনান সিদ্দিকী পালাতে না পেরে পাশের একটি ভবনে লুকাতে চেষ্টা করেন। তবে স্থানীয়রা তাকে ধরে পুলিশে দেয়।

পুলিশের তদন্তে জানা যায়, ২৪ জুলাই রাতে সোহেল চৌধুরী ও তার কয়েকজন বন্ধু সেই ক্লাবে যান। সেখানে বিতর্কিত ধনকুবের আজিজ মোহাম্মদ ভাইও ছিলেন। সেদিন রাতে বনানীর ট্রাম্প ক্লাবে গান বন্ধ করতে বলেছিলেন সোহেল চৌধুরী ও তার বন্ধুরা। এ নিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেলের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে সোহেল চৌধুরী আজিজের ওপর ক্ষেপে যান। তখন সোহেলের এক বন্ধু গুলি করতে যান আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে। এ সময় ক্লাবের শৌচাগারে ঢুকে আত্মরক্ষা করেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। এই ট্রাম্প ক্লাবের মালিকানা ছিল বান্টি ইসলাম ও আশীষ চৌধুরীর।

সোহেল চৌধুরী হত্যা নিয়ে তার মা নূরজাহান বেগম আদালতকে বলেন, সোহেল খুন হওয়ার ১৫ থেকে ২০ দিন আগে টেলিফোনে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও বান্টি ইসলামের লোকজন হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, সোহেলের মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে আসছে।

সর্বশেষ খবর