সোমবার, ১৩ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

ঘুরে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জে সরকার

রফিকুল ইসলাম রনি

ঘুরে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জে সরকার

টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের পাঁচ মাস পার হয়েছে। নবীন-প্রবীণদের নিয়ে গঠিত সরকারের সামনে অনেক বিষয়ে সতর্কতা রয়েছে। এর মধ্যে মোটা দাগে রয়েছে, ডলার সংকট কাটিয়ে ওঠা, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফেরানো। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরা। নানা অনিয়ম, দুর্নীতি রোধ করা। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা। অন্যদিকে রপ্তানি আয়, বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সৃষ্ট টানাপোড়েন তথা সম্পর্কের বরফ গলানোর মতো বিষয়গুলো নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তৎপর হতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে সরকারবিরোধী অপপ্রচার রোধ করাসহ ঘরে-বাইরের এসব চ্যালেঞ্জের উত্তরণ ঘটাতে হবে বর্তমান সরকারকে। গত ২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদ থেকে গেল ১৫ বছরের বেশি সময়ে নতুন মাত্রা পেয়েছে দেশের অর্থনীতি। মাথাপিছু আয়, প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ, রপ্তানি-রেমিট্যান্স রেকর্ড হয়েছে। কিন্তু মহামারি করোনা, আর ইউক্রেন যুদ্ধ সবকিছু ওলটপালট করে দেয়। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে গেছে। সংকট দেখা দিয়েছে ডলারের। অর্থনৈতিক সংকট প্রকট। এর বাইরে নানা অব্যবস্থাপনা, দ্রব্যমূলের চড়া দাম মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। তাই সরকারকে নানা দিক ভেবেচিন্তে পা ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

দেড় দশকে অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলীয় ইশতেহার ঘোষণার সময় এই স্বপ্ন দেখান তিনি। সে পথেই হাঁটছে বর্তমান সরকার। বর্তমানে যেসব সংকট রয়েছে, সেগুলো সমাধানের জন্য সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করে সামনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন রাজনীতি ও সমাজ ও অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ প্রকাশ্য রূপ নিতে পারে। সে কারণে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনাকে সরকারের অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। বিশেষত রিজার্ভ সংকট ও মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য বড় সংকট সৃষ্টি করেছে। দ্রব্যমূল্য কমিয়ে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে দেওয়া নতুন সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। এখন ডলার সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো এলসি খুলতে পারছেন না। কাজেই দ্রুতই এ সংকট সমাধান করতে হবে। ব্যাংক খাতেও নানা সংকট চলছে। খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। অনেকে সঠিক কাগজপত্র দিয়েও ব্যাংকের ঋণ পায় না। আবার অনেকে ভুয়া কাগজ দেখিয়ে কোটি কোটি ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন। সেগুলোও উদ্ধারে সঠিক পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডলার সংকট নিয়ে আমরা আগে থেকেই বলে আসছি, অনেক দেরিতে হলেও সরকার সে পথেই হাঁটছে। ডলারের বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক করে দিচ্ছে। যদিও এতে টাকার অনেক অবমূল্যায়ন হয়েছে। এতে মাকের্টটা কিছুটা হলেও স্থিতিশীল হবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে একটু সময় লাগবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই নীতি ধরে রাখলে কিছুদিন পর মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করবে, ছেড়ে দিলে হবে না। ব্যাংকিং খাতের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ব্যাংক খাতের অনিয়ম দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। এই সমস্যা আইন করে সমাধান করা যাবে না। রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করে অনিয়ম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যাংক একীভূত করণের যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, সেটাও বাস্তবায়ন করতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপচার্য ড. মীজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অর্থনীতিতে সংকট আছেই। রিজার্ভ বাড়ানো দরকার। মুদ্রাস্ফীতির হার মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। ব্যাংক থেকে যেসব টাকা চলে গেছে, সেগুলো উদ্ধারে উদ্যোগ নিতে হবে। ঋণ খেলাপি বা অর্থ পাচারকারীদের শুধু জেল দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। জেল দেওয়ার পাশাপাশি অর্থ উদ্ধারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে সেগুলো বন্ধ করতে হবে। বিএনপিসহ তাদের মিত্ররা সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে চাইবে। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এ ছাড়াও সরকারবিরোধী সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার রোধে শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। তারা এখন পর্যন্ত এই নির্বাচন মেনে নেয়নি। তারা নির্বাচনের বিরুদ্ধে এবং নতুন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। এই আন্দোলনে তারা কতটুকু সফল হতে পারে সেটি পরের বিষয়। কিন্তু বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা করার জন্য আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে চরম দুর্বল। এই দুর্বল সংগঠন নিয়ে কতটা রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে সেই প্রশ্ন থেকে যায়। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের নেতিবাচক মনোভাব ছিল। এর ফলে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নতুন মেরুকরণ হয়েছে। এক্ষেত্রে জোরদার কূটনীতি দরকার। সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। কূটনৈতিকরা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, তা এখন নেই। নির্বাচন প্রায় সব দেশ মেনে নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশের সামনে সব সময়ই চ্যালেঞ্জ ছিল। এখনো আছে। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তো সব দেশ মেনে নিয়েছে। সরকারকে সমর্থন জানিয়েছে। কাজেই খুব বেশি চ্যালেঞ্জ আমি দেখছি না।’ এখন সারা দেশে উপজেলা নির্বাচন চলছে। এই নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশি হচ্ছে। সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রীদের আধিপত্ত বিস্তারের কারণে তৃণমূলে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। উপজেলা ভোটকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে হামলা-সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে নানা সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটার শঙ্কা করা হচ্ছে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা দরকার বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আওয়ামী লীগ সরকারই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলছে। সেই ডিজিটালের সুবিধা নিয়ে সরকার বিরোধীরা দেশ-বিদেশে বসে নানা মিথ্যাচার করে চলছে। সরকার এগুলো শক্তহাতে মোকাবিলা করতে পারছে না। শুধু সরকারের বিরুদ্ধেই নয়, সমাজের আলোকিত ও পরিচিত বা আওয়ামী লীগের জন্য যারা নানা ভাবে ভূমিকা রাখছেন তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে চলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারকে এগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে। মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য তুলে ধরে জবাব দিতে হবে।

সর্বশেষ খবর