লোকসভা (ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ) নির্বাচনে গতকাল চতুর্থ দফার ভোট গ্রহণকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গ ও অন্ধ্র প্রদেশে সহিংসতা, গণ্ডগোল, অশান্তি হয়েছে। বোমা মেরে এক ব্যক্তিকে খুন করার সংবাদ এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং প্রধান বিরোধী দল বিজেপি পাল্টাপাল্টি অভিযোগে লিপ্ত হয়েছে। অন্যদিকে অন্ধ্রপ্রদেশে তেলেগু দেশম পার্টি এবং ওয়াইএসআর কংগ্রেসের মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ।
নির্বাচনকেন্দ্রিক যে কোনো অশান্তি রুখতে প্রস্তুত ছিলেন কুইক রেসপন্স টিম, ফ্লাইং স্কোয়াড, ভিডিও সার্ভেলেন্স টিম, স্ট্যাটিক সার্ভেলেন্স টিমের সদস্যরা। কিন্তু ঠেকানো গেল না সহিংসতা, ঝরল রক্ত, প্রাণ গেল নিরীহ মানুষের, রেয়াত পেল না গণমাধ্যমের গাড়িও। সোমবার চতুর্থ দফায় ১০টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলজুড়ে ৯৬টি সংসদীয় আসনে ভোট নেওয়া হয়। পঞ্চম দফায় ভোট হবে ২০ মে।
লোকসভার পাশাপাশি এদিন অন্ধ্রপ্রদেশের ১৭৫ আসনে এবং ওড়িশার ২৮টি আসনে বিধানসভার ভোট নেওয়া হয়। বোলপুর লোকসভা আসন এলাকার কেতুগ্রামের চেঁচুড়ি গ্রামে নৃশংসভাবে খুন হলো এক ব্যক্তি। রবিবার রাতে মিন্টু শেখ নামে ৪৫ বছর বয়সী ওই ব্যক্তিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর পাশাপাশি বোমা মেরে খুন করা হয়। মিন্টু শেখ যখন তার এক সঙ্গীকে নিয়ে বাইকে চড়ে বাড়ি ফিরছিলেন, সে সময় কয়েকজন দুষ্কৃত তার বাইক আটকায়। তিনি বাইক থামাতেই তার শরীরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ মারা হয়, পরে মৃত্যু নিশ্চিত করতে দুষ্কৃতরা বোমা মারে। এদিন সকালের দিকে বর্ধমান-দুর্গাপুর আসন এলাকার মন্তেশ্বর ব্লকের টুললা এলাকায় বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষের গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখায় গ্রামবাসীরা। তার গাড়ির সামনে শুয়ে পড়ে এক গ্রামবাসী। মুহূর্তের মধ্যেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়। এক সময় দিলীপ ঘোষকে ঘিরে ধীরে ‘গো ব্যাক’ স্লোগানও দেওয়া হয়। এরপর দিলীপ ঘোষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষীরা তৃণমূল কর্মীদের দিকে এগিয়ে যান। পরে লাঠির মারে একজন আহত হন বলে অভিযোগ। এই সংবাদসংগ্রহ করতে গিয়ে গণমাধ্যমের গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। বেলা গড়াতেই বিকালবেলা ফের দিলীপ ঘোষের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে। বর্ধমান-উত্তর ২০৪ নম্বর বুথের দলীয় এজেন্টকে বের করে দেওয়ার খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান দিলীপ ঘোষ। এই হামলায় আহত হন দিলীপ ঘোষের দুই নিরাপত্তারক্ষী। এর মধ্যে একজনের মাথা ফেটে রক্ত বেরোতে থাকে। নিরাপত্তা রক্ষীদের গাড়িবহরেও ভাঙচুর করা হয়।দুর্গাপুর ১২ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি কর্মীদের মারধর ও গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ বিজেপি কর্মী ও এলাকাবাসী রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায়। পরে ঘটনাস্থলে বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়। কৃষ্ণনগর আসন এলাকার তেহট্টের রামজীবনপুরের কয়েকটি বুথে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। ভোট দিতে আসার সময় বিজেপি কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বাঁশ ও লাঠি দিয়ে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। তৃণমূলের দাবি এটা বিজেপির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। ভোট দেখতে গিয়ে গ্রামবাসীদের অভাব-অভিযোগের মুখে পড়েন বীরভূমের তৃণমূল প্রার্থী শতাব্দী রায়। শতাব্দীর গাড়িবহরের সামনে এসে এক বৃদ্ধা নারী ক্ষোভ উগড়ে দেন। বোলপুরে আট গ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি বুথে তৃণমূলের বিরুদ্ধে জাল ভোটের অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া একাধিক জায়গা থেকেই ইভিএম বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটে, ফলে সেসব কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ শুরু হতে দেরি হয়। এতে কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়।
দুর্গাপুরে তানসেন রোডের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের ক্যাম্প অফিস বিজেপি ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তৃণমূল কর্মীদের অভিযোগ তারা যখন মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য গিয়েছিলেন সেই সুযোগে বিজেপির বহিরাগতরা বাইক বাহিনী নিয়ে এসে তাদের নারী সদস্যদের ওপর হামলা চালায় এবং ক্যাম্প অফিসে ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় তৃণমূলের কয়েকজন মহিলা কর্মী আহত হন। ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি লেগে গেলে ঘটনাস্থলে আসে বিশাল পুলিশ বাহিনী। অন্যদিকে অন্ধ্রপ্রদেশের পালনাডু, কাদাপা, আন্নামায়া জেলার একাধিক জায়গায় ওয়াইএসআর কংগ্রেস এবং টিডিপি নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ এনেছে। রাজ্যটির টেনালি এলাকায় ওয়াইএসআর কংগ্রেস বিধায়ক শিবকুমার, তার সহযোগী ও অন্য ভোটাররা ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। সে সময় হঠাৎ করে এক ভোটারকে চড় মারেন বলে অভিযোগ। পাল্টা ওই ভোটারকেও চড় মারতে দেখা যায়। ওয়াইএসআর কংগ্রেসের অভিযোগ, তাদের দলের সিনিয়র নেতা নন্দীরাম সুরেশের গাড়িতে চড়াও হয় এবং চিতোরে তার বুথ এজেন্টকে মারধর করা হয়। টিডিপির অভিযোগ মাইদুরুকু কেন্দ্রের তাদের প্রার্থীর এজেন্টকে মারধর করা হয়, এর ফলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এদিকে একটি ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে বোরখা পরিহিত নারী ভোটারদের নিকাব খুলে যাচাই করার অভিযোগ উঠেছে হায়দরাবাদ কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী মাধবী লতার বিরুদ্ধে। প্রার্থী যখন বিভিন্ন কেন্দ্রে ঘুরছিলেন তখনই একটি ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে বেশ কিছু মুসলিম ভোটার ভোটের লাইনে অপেক্ষা করছিলেন। সে সময় নিকাব খুলে তাদের পরিচয় যাচাই করেন মাধবীলতা। এই ঘটনায় স্থানীয় মালাকপেট থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয় মাধবীলতার বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে প্রার্থী জানান ‘আমি একজন প্রার্থী। আমার অধিকার আছে ভোটার কার্ডের সঙ্গে প্রার্থীর মুখমণ্ডল মিলিয়ে নেওয়া।’ চতুর্থ দফায় পশ্চিমবঙ্গের আটটি আসনে ভোট হয়। এগুলো হচ্ছে : বহরমপুর, কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, বর্ধমান পূর্ব, বর্ধমান-দুর্গাপুর, আসানসোল, বোলপুর, বীরভূম। এই কেন্দ্রগুলোর মধ্যে তৃণমূলের পাঁচটি, বিজেপি দুটি এবং কংগ্রেসের দখলে রয়েছে একটি আসন।
বহরমপুর আসনে কংগ্রেস প্রার্থী অধীর রঞ্জন চৌধুরী। এবার তার প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী সাবেক ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান। বিজেপি প্রার্থী ড. নির্মল কুমার সাহা। কৃষ্ণনগর আসনে তৃণমূলের প্রার্থী মহুয়া মৈত্র। এই কেন্দ্রে তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপি প্রার্থী রাজমাতা অমৃতা রায়, সিপিআইএম প্রার্থী এসএম সাদি। রানাঘাট আসনে বিজেপি প্রার্থী জগন্নাথ সরকার, তৃণমূলের রার্থী মুকুটমণি অধিকারী। সিপিআইএম প্রার্থী অলোকেশ দাস। বর্ধমান-পূর্ব আসনে তৃণমূল প্রার্থী ডা. শর্মিলা সরকার, বিজেপির অসীম সরকার, সিপিআইএম প্রার্থী নীরব খাঁ। বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে তৃণমূলের প্রার্থী সাবেক ক্রিকেটার কীর্তি আজাদ, বিজেপির প্রার্থী দিলীপ ঘোষ, সিপিআইএম প্রার্থী সুকৃতি ঘোষাল। আসানসোল আসনে তৃণমূলের প্রার্থী হিন্দি ফিল্মের ‘বিহারী বাবু’ বলে পরিচিত শত্রুঘ্ন সিনহা, বিজেপি প্রার্থী সুরেন্দ্রজিৎ সিং আলুওয়ালিয়া, সিপিআইএম প্রার্থী জাহানারা খান। বোলপুর আসনে তৃণমূল প্রার্থী অসিত কুমার মাল, বিজেপির পিয়া সাহা, সিপিআইএমের প্রার্থী শ্যামলী প্রধান। বীরভূম আসনে গত তিনবারের সংসদ সদস্য অভিনেত্রী শতাব্দী রায়, বিজেপির প্রার্থী দেবতনু ভট্টাচার্য, কংগ্রেস প্রার্থী মিল্টন রশিদ।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সোমবার ব্যারাকপুর লোকসভা আসন এলাকার পলতায় এক জনসভায় বক্তৃতাকালে মোদিকে ‘বিদায়’ করার ডাক দিয়ে বলেন, ৩৪ বছর লড়াই করে যদি সিপিএমকে হারাতে পারি তবে বিজেপিকেও হারাতে পারব। এটাই আমাদের চ্যালেঞ্জ। ওরা বলছে ইসবার ৪০০ পার, আমি বলি এবার পগার পার। এবার বিরোধী দলের জোট ‘ইন্ডিয়া’ই জিতবে।
