মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা
হাই কোর্টের রায়

মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্তের আগে কনডেম সেলে নয়

নিজস্ব প্রতিবেদক

সব ধরনের বিচারিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া দণ্ডিতকে কনডেম সেল বা নির্জন কারাকক্ষে রাখা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন হাই কোর্ট। এ-সংক্রান্ত রুল নিষ্পত্তি করে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ পর্যবেক্ষণসহ এ রায় দেন। গতকাল সকাল ১১টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা এ রায় দেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন শুনানি করেন। আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন মোহাম্মদ শিশির মনির। রুল শুনানিতে আদালত এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী ও এস এম শাহজাহান বিশেষজ্ঞ মত নেন। গত বছর ১২ ডিসেম্বর এই রিট আবেদনের শুনানি শেষ হয়। আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বন্দিদের সঙ্গে অন্য বন্দিদের মতোই আচরণ করা উচিত। ব্যতিক্রম পরিস্থিতি, যেমন ছোঁয়াচে রোগ বা সমকামিতা থাকলে বিশেষ বিবেচনায় যেকোনো বন্দিকে বিচ্ছিন্ন কক্ষে রাখা যেতে পারে। আদালত বলেন, এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া বন্দিদের অন্য বন্দিদের মতো জামিন আবেদনের অনুমতি দেওয়া উচিত। উপযুক্ত ক্ষেত্রে হাই কোর্টের উচিত ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারা অনুসারে আবেদনকারীকে জামিন দেওয়া। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যা মামলার ঘটনা তুলে ধরে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, গত ১২ বছর ধরে তদন্ত হচ্ছে, এখনো তদন্ত শেষ হচ্ছে না। বিচার তো আরও পরের স্টেজ। আমাদের দেশে ট্রায়াল স্টেজ শেষ হতেই ৫ থেকে ১০ বছর লেগে যায়। এই ধরনের বিলম্ব যেখানে হয়, সেখানে মৃত্যুদণ্ডের আসামিকে নির্জন সেলে ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত যদি বন্দি রাখা হয়। তাহলে এটি ডাবল শাস্তি হয়। এটি সংবিধান ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা অনুমোদন করে না। তাই বর্তমানে কনডেম সেলে থাকা আসামিদের দুই বছরের মধ্যে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বিষয়ে সাংবাদিক ও গবেষকরা তথ্য চাইলে তা সরবরাহ করতে কারা কর্তৃপক্ষ ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয়কে বলা হয়েছে রায়ে। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ-সংক্রান্ত তথ্য বিস্তারিত উল্লেখ করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাই কোর্ট। রিটের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ আদালতকে জানিয়েছিল, নতুন জেলকোড তৈরি হচ্ছে। নতুন আইন ‘প্রিজন অ্যাক্ট’ হচ্ছে। হাই কোর্ট রায়ে বলেছেন, রায়ের পর্যবেক্ষণ যেন নতুন আইনে প্রতিফলিত হয়, সেটা বিবেচনা করতে। রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, এ রায়ের বিষয়ে আপিল করা হবে কি না, এ বিষয়ে আলোচার পর সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি।

রায়ের পর রিটকারীদের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড হলেই কাউকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বলা যাবে না। এর জন্য হাইকোর্ট বিভাগ, আপিল বিভাগ ও রাষ্ট্রপতির কাছে করা আবেদন খারিজ হতে হবে। আর এসব প্রক্রিয়া শেষে কারও মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলেই তাকে মৃত্যুর সেলে বা কনডেম সেলে রাখা যাবে বলে রায় দিয়েছেন হাই কোর্ট। চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের কনডেম সেলে রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর হাই কোর্টে রিটটি করেন চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লা কারাগারের কনডেম সেলে বন্দি তিন কয়েদি সাতকানিয়ার জিল্লুর রহমান, সুনামগঞ্জের আবদুল বশির ও খাগড়াছড়ির শাহ আলম। ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর রিট আবেদনের শুনানি হয়। তখন রাষ্ট্রপক্ষের অনুরোধে হাই কোর্ট রুল জারি না করে কনডেম সেল ও কনডেম সেলে বন্দিদের সংখ্যা, কারাগারের সংস্কার, ব্যবস্থাপনা, কনডেম সেলের সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেন। দীর্ঘদিন পর রিট আবেদনটি হাই কোর্টের আরেকটি বেঞ্চে উত্থাপন করা হয়। শুনানির পর ওই বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেন। ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেওয়া কারা কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের কারাগারগুলোতে কনডেম সেল রয়েছে ২ হাজার ৬৫৭টি। এর মধ্যে পুরুষের জন্য ২ হাজার ৫১২টি ও নারীদের ১৪৫টি সেল রয়েছে। এসব সেলে মোট বন্দি আছেন ২ হাজার ১৬২ জন, যাদের মধ্যে পুরুষ বন্দি ২ হাজার ৯৯ জন ও নারী বন্দি ৬৩ জন। সর্বোচ্চ সংখ্যক কনডেম সেল রয়েছে ঢাকা বিভাগের কারাগারগুলোতে। ঢাকা বিভাগের কারাগারগুলোতে থাকা ১ হাজার ৮৪টি সেলে বন্দি আছেন ১ হাজার ২৯৫ জন। সবচেয়ে কম ৫৪টি কনডেম সেল ময়মনসিংহ বিভাগে। ওই বিভাগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া পাঁচ আসামি আছেন কনডেম সেলে, যাদের সবাই পুরুষ।

 

সর্বশেষ খবর