শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

মহাসড়ক যেন মৃত্যুকূপ

২২টিতে থ্রি-হুইলারের দাপট ♦ বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা ♦ চাঁদায় বৈধ অবৈধ যান

শিমুল মাহমুদ ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

মহাসড়ক যেন মৃত্যুকূপ

দেশের সড়ক-মহাসড়ক এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। সরকারি হিসাবেই গত বছর ৫ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ দিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনার নামে। পঙ্গুত্ব বরণ করেছে আরও অসংখ্য মানুষ। গত এক যুগে ব্যাপক বিনিয়োগে অবকাঠামো উন্নয়ন হলেও সড়ক পরিবহন খাতে কোনো শৃঙ্খলা আসেনি। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরও দেশের ২২ মহাসড়কে বন্ধ হয়নি থ্রি-হুইলার, নসিমন, করিমন, সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। চার লেনের মহাসড়কগুলোয় বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বিলাসবহুল বাস চলে। তার পাশেই চলে ব্যাটারিচালিত ধীরগতির বিপজ্জনক থ্রি-হুইলার, নসিমন, করিমন, ইজিবাইক। দ্রুতগতির যাত্রীবাহী বাসের সামনে হঠাৎ চলে আসে উল্টোপথের ছোট গাড়ি। ফলে বিশৃঙ্খল সড়কে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে বারবার ঘোষণা দিয়েও মহাসড়ক থেকে বিপজ্জনক যান সরানো যাচ্ছে না। কমছে না সড়ক দুর্ঘটনা। সড়ক পরিণত হয়েছে মৃত্যুকূপে। মহাসড়কে চলাচলকারী এসব ছোট গাড়ি থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলছে রাজনৈতিক কর্মী ও পুলিশ। চাঁদায় বৈধ হয়ে যাচ্ছে অবৈধ ঘোষিত এসব বিপজ্জনক যান। এজন্য সড়ক থেকে কোনোভাবেই হটানো যাচ্ছে না এসব যান।

মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার ইজিবাইক চলাচল থেকে বিরত রাখতে আদেশ দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু এ আদেশের তোয়াক্কা না করে মহাসড়কে বিনা বাধায় চলছে ইজিবাইক। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সম্প্রতি দেশের কোন সড়কে কত গতিতে কোন ধরনের যানবাহন চলবে, তা ঠিক করে দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এ নির্দেশিকা রোডক্র্যাশ ও প্রতিরোধযোগ্য অকালমৃত্যু ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়েছে রোড সেফটি কোয়ালিশন বাংলাদেশ। একই সঙ্গে এ নির্দেশিকার যথাযথ বাস্তবায়ন ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে আনতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছে সংগঠনটি।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ১ হাজার ৪৬৪ সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৩৬৭ জন নিহত ও ১ হাজার ৭৭৮ জন আহত হয়েছে। সে হিসেবে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে সড়কে। আর এবার ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে ১৪ দিনে সড়কে ৩৫৪ দুর্ঘটনায় অন্তত ২৭৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ঈদযাত্রায় সড়কে প্রতিদিন গড়ে ১৯ জনের বেশি নিহত হয়েছে। গত ১৫ বছরে সড়ক পরিবহন খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ, সড়ক নিরাপত্তায় প্রচার ও মহাসড়ক নিরাপদ করতে ধীরগতির যানবাহন চলাচলে বিভিন্ন সড়কে হাজার হাজার কোটি টাকায় সার্ভিস লেন নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সেগুলোর ব্যবহার তেমন নেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মতো যেসব মহাসড়কে সার্ভিস লেন নেই সেখানে দূরপাল্লার বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে থ্রি-হুইলার, ইজিবাইক। দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হলেও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে সড়কে থ্রি-হুইলার, নসিমন, করিমন, ভটভটির মতো অনুমোদনহীন যানবাহন বন্ধে সরকার আগ্রহী নয়। গত ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় তা আলোচিত হয়েছে। এ ব্যাপারে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও সরকার পিছিয়ে গেছে। মহাসড়ক থেকে এসব ধীরগতির ছোট যান তুলে দিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা কার্যকর হচ্ছে না। মহাসড়কে মোট দুর্ঘটনার অন্তত ৩০ শতাংশ এসব ছোট গাড়ির কারণে সংঘটিত হচ্ছে। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনে সড়কের নিরাপত্তায় শাস্তি বহুগুণ বাড়িয়ে আইন করা হয়। গত পাঁচ বছরেও সে সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন করা যায়নি। উপরন্তু পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চাপে সম্প্রতি সে আইনে শাস্তি ও জরিমানার পরিমাণ কমানো হয়েছে। দুর্ঘটনা রোধে ১১১ দফা সুপারিশ জমা দিয়েছে উচ্চক্ষমতার কমিটি। সুপারিশ বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে টাস্কফোর্স হয়েছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৭ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন ছয় দফা নির্দেশনা। কিন্তু সড়কে কিছুই ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দুর্ঘটনাও রোধ হচ্ছে না। সড়ক নিরাপত্তায় মহাসড়কে বসানো হয়েছে স্পিডমিটার, সিসি ক্যামেরা। ২০০৫ সাল থেকে মহাসড়কে কাজ করছে হাইওয়ে পুলিশ। মহাসড়কে সড়ক আইনের প্রয়োগ, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা, অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ নানা কাজ তাদের। ২ হাজার ৮০০ সদস্যের এ বাহিনীর আওতায় সারা দেশে ৮০টির মতো থানা ও ফাঁড়ি রয়েছে। তার পরও সড়কে কোনো শৃঙ্খলা ফিরছে না।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলে উল্টোপথের গাড়ি : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বিভিন্ন পয়েন্টে উল্টোপথে চলাচল করে ঝুঁকিপূর্ণ থ্রি-হুইলার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক। মাসোহারা দিয়ে উল্টোপথে দিনভর চলাচল করছে নিষিদ্ধ এসব ছোট গাড়ি। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ে প্রাণহানি ঘটছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে শিমরাইল মোড় ও শিমরাইল মোড় থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত শত শত ইজিবাইক ও অটোরিকশা চলাচল করছে উল্টোপথে। স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী ও পুলিশকে গাড়িপ্রতি মাসোহারা দিয়ে নির্বিঘ্নে চলছে এসব পরিবহন। শিমরাইল মোড় নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের পশ্চিম পাশের কোনা থেকে মহাসড়কে উল্টোভাবে চলাচল করছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটোরিকশা। অন্যদিকে দাউদকান্দি থেকে চান্দিনা, বিশ্বরোডসহ বিভিন্ন স্থানে চলছে এসব যান। সানারপাড় থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত মহাসড়কে কোনো ডিভাইডার বা ইউটার্ন না থাকায় সময় বাঁচাতে অনেক পরিবহন উল্টোভাবে চলে বলে জানান একটি ইজিবাইকের চালক ইমরান। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার ১০৫ কিলোমিটারে মোড়ে মোড়ে অবৈধ পার্কিং, তিন চাকার যান চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজার এলাকায় বিভিন্ন মালামাল নিয়ে নসিমন, করিমন ও ভটভটি অবাধে চলছে। সদর দক্ষিণ উপজেলার সুয়াগাজী এলাকায় মহাসড়কের ওপরই সিএনজিচালিত অটোরিকশার অঘোষিত স্ট্যান্ড। একই অবস্থা মহাসড়কের পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড, কোটবাড়ী বিশ্বরোড, আলেখার চর বিশ্বরোড, সেনানিবাস এলাকায়। এসব স্থানে উল্টোপথেও চলাচল করে এসব নিষিদ্ধ যানবাহন। এ ছাড়া মহাসড়কের নিমসার, চান্দিনা, ইলিয়টগঞ্জ, গৌরিপুরসহ দাউদকান্দির বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ পার্কিং দেখা গেছে। গৌরিপুর বাজারের ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন বলেন, ‘সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশাসহ অবৈধ তিন চাকার যানবাহনের দখলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গৌরিপুর। এতে মহাসড়কে চলাচলরত দূরপাল্লার যানবাহন, অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসসহ জরুরি সেবার যানবাহনগুলোকে যানজটের কবলে পড়তে হচ্ছে।’

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা নজর রাখছি। ধীরগতির যানবাহন, থ্রি-হুইলার, মোটরসাইকেল যে যেমন পারছে সর্বোচ্চ গতিতে মহাসড়কে চলাচল করছে। গতি কমলে জীবন বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু আইন মানতে ভীষণ অনীহা। মানুষকে সচেতন করাই আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ‘চালকের পাশাপাশি সামনের এবং পেছনের সিটে বসে থাকা যাত্রীরা সিটবেল্ট বাঁধলে দুর্ঘটনায় প্রাণনাশের হার ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। মোটরসাইকেলের চালক যদি মানসম্পন্ন হেলমেট পরেন তাহলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ৪০ শতাংশ এবং গুরুতর আহত হওয়ার ঝুঁকি ৭০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। এর পাশাপাশি ৫% গতি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ৩০ % রোডক্র্যাশ রোধ করা সম্ভব। এ গতি নিয়ন্ত্রণে গত ৫ মে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় “মোটরযানের গতিসীমা নির্দেশিকা, ২০২৪” প্রণয়ন করেছে। এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। নির্দেশিকায় প্রথমবারের দেশের সব রাস্তার ধরন অনুযায়ী একটি সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করা হলো।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক বলেন, ‘শুধু অবকাঠামোর উন্নয়ন করে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব না। পরিসংখ্যান তো তা-ই বলে। দ্রুতগতির সড়কে যদি ধীরগতির যানবাহন চলাচল করে তাহলে যে গতির বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় এতে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ে। আমরা অনেক সময় দেখি গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে গেছে বা ট্রাক উল্টে গেছে। এর মূল কারণ দ্রুতগতির সড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচল। অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, সামনে কোনো ইজিবাইক বা সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে বাঁচাতে গিয়ে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বহু লোকের প্রাণ গেছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর