শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

সারা দেশে ১৭৩ কিশোর গ্যাং

এক বছরে রাজধানীতে খুন ২৪, সাত বছরে গ্রেফতার ১ হাজার ৬৯১, বিভিন্ন অপরাধে মামলা ৭৮০

মাহবুব মমতাজী

সারা দেশে ১৭৩ কিশোর গ্যাং

গত ২২ এপ্রিল রাতে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় বৈশাখী মেলায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয় প্রতিপক্ষ গ্যাংয়ের সদস্য শিপন মিয়া (১৬)। ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে যশোরে আকাশ হোসেন (২৮) নামে একজনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। ৯ ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে ছাত্রীদের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয় নীরব হোসেন (১৭)। এর সপ্তাহখানেক আগে ৩ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীর চর থেকে মিলন হোসেন (২৭) নামে এক যুবকের ৯ টুকরা লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানায়, মিলন একটি কিশোর গ্যাংয়ের বড় ভাই। প্রতিপক্ষ গ্যাংয়ের হাতে তিনি খুন হন। কিশোর গ্যাংয়ের খুনোখুনির এমন চিত্র এখন সারা দেশে। হালে ঢাকাসহ সারা দেশে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাে  এই কিশোররা ব্যবহৃত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টে গেছে। বর্তমানে সারা দেশে ১৭৩টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। গত ১৯ বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে অন্তত ১২০ জনের বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় চার শতাধিক কিশোরকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে গত বছরই খুন হয়েছে ২৬ জন।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ও র‌্যাব। উভয় সংস্থা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক ‘বড় ভাই’দের তালিকা করা শুরু করেছে। সূত্র জানায়, গত মাসে অনুষ্ঠিত ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মাসিক অপরাধ সভায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা, স্থান নির্ধারণ করার নির্দেশ দেন। সম্প্রতি রাজধানীর এফডিসিতে এক অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, রাজধানীর ৫০টি থানার মধ্যে ১০টি থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্যের অপরাধ লক্ষ্য করা যায়। এসবের মধ্যে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী ও উত্তরা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেশি। তিনি বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের মদতদাতা যারা রয়েছে তাদের তালিকা করা হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের অদ্ভুত অদ্ভুত নাম রয়েছে, তাদেরও তালিকা হয়েছে। এর আগে ২০২২ সালে সারা দেশের কিশোর গ্যাং নিয়ে পুলিশ একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে অন্তত ১৭৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধে এদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৭৮০টি। এসব মামলায় আসামি প্রায় ৯০০ জন। রাজধানীতে কিশোর গ্যাং রয়েছে ৬৬টি। চট্টগ্রাম শহরে আছে ৫৭টি। মহানগরের বাইরে ঢাকা বিভাগে রয়েছে ২৪টি গ্যাং।

র‌্যাবের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৯১ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে গত বছরই গ্রেফতার হয়েছে ৩৪৯ জন। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১৬, ফেব্রুয়ারিতে ১৮৯, মার্চে ২৭৫ এবং এপ্রিলে গ্রেফতার হয় ৮৫ জন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে কিশোর গ্যাং কালচার শুরু হয়েছিল সুবিধাবঞ্চিত, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব থেকে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরেপড়া কিশোরদের নিয়ে। পরবর্তীতে তথাকথিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য এদের ব্যবহার শুরু করে। অস্ত্রবাজি, মাদক ও হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাে  এদের ব্যবহার করা হয়। একটি গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ জন। এখন মিশ্র বয়স নিয়ে চলছে কিশোর গ্যাং। শুধু কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলে এর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এর পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে এর জন্য সামাজিক সমাধান প্রক্রিয়াও যুক্ত করতে হবে।

জানা গেছে, ২০২০ সালের ৩০ আগস্ট পুরান ঢাকার ওয়ারীতে দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মুন্না নামে এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ৭ সেপ্টেম্বর সবুজবাগে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জেরে কিশোর জব্বারকে খুন করা হয়। আগের বছর ২০১৯ সালের ২১ মার্চ উত্তরখানে ‘বিগ বস’ এবং ‘কাশ্মীরি’ গ্রুপের সংঘর্ষে কামরুল হাসান হৃদয় খুন হয়। ওই কিশোর ‘বিগ বস’ গ্রুপের সদস্য ছিল। ২০১৯ এবং ২০২০ সালে এই  দুই বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ৩৪টি খুনের ঘটনা ঘটে। ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু এ প্রতিবেদককে বলেন, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের আইনগত কোনো দুর্বলতা নেই। কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপে কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাদের সৎ ও সচেতনভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাদের সামাজিকভাবে পুলিশকে সহযোগিতা করতে হবে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম বলেন, যেখানেই মাদক, সেখানেই অপরাধের উৎস। কিশোর গ্যাং পশ্চিমা সংস্কৃতির একটি অংশ। গত দেড় দশক ধরে আমরা কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছি। প্রথমে এদের কর্মকা  এমন সন্ত্রাসীমূলক ছিল না, কিন্তু ইদানীং আমরা দেখতে পাচ্ছি- এরা অন্তর্ঘাতমূলক সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এরপর হত্যাসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। সমাজের কিছু অসাধু বড় ভাই তাদেরকে মাদকে ব্যবহার করছে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের অধিকাংশই মাদকসেবী। একই সঙ্গে তারা ক্রেতা এবং বিক্রেতা। তবে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করে যাচ্ছি কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে। প্রথমে কিশোর অপরাধী যারা- তাদের চিহ্নিত করছি, এরপর যারা তাদের লালনপালন করছে এবং যারা বড় ভাই, এই বড় ভাইদেরও তালিকা তৈরি হচ্ছে। আপনারা শিগগিরই এর একটা ফল দেখতে পাবেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর