শিরোনাম
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা
স্মরণ

তুমি রবে সরবে হৃদয়ে মম

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

তুমি রবে সরবে হৃদয়ে মম

কবিগুরু আজ বেঁচে থাকলে প্রয়াত আবদুুল গাফ্ফার চৌধুরীকে নিয়ে লিখতে গেলে কবিতার ভাষায় কিঞ্চিত পরিবর্তন এনে, এমনটাই লিখতেন। এ ঘাত-প্রতিঘাতের পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তিনি সবার মনেই বিরাজ করছেন, তবে নীরবে নয়, বরং সরবে। জীবিতাবস্থায় তিনি যেমন সরব ছিলেন সব কুসংস্কার, অন্যায়, নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিরুদ্ধে, তার কোটি কোটি গুণগ্রাহী সেই সরব গাফফার ভাইকেই মনের গভীরে ধারণ করে আছেন। গাফফার ভাইয়ের সারা জীবনের অন্যতম ব্রত ছিল সাম্প্রদায়িকতার মূল উৎপাটন। তার প্রাথমিক শিক্ষা মাদরাসায় হয়েছিল বলে ধর্মান্ধদের চিহ্নিত করতে, তাদের পরিকল্পনা বুঝে নিতে গাফফার ভাইকে বেগ পেতে হতো না। মাদরাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে তিনি জানতেন কোনো ধর্মই বিভেদ আর হানাহানি সমর্থন করে না, বরং সম্প্রীতির বাণীই হচ্ছে সব ধর্মের মূল প্রতিপাদ্য। তিনি জানতেন আজ ওয়াজের নামে কিছু অর্থলোভী তথাকথিত হুজুর ধর্মের ভিত্তিতে বিভেদ, হিংসা, ঘৃণা, জিঘাংসা প্রসারের যে কথা বলে বেড়াচ্ছে, অর্থের বিনিময়ে তা কখনো ইসলাম ধর্মের কথা নয়। এরা ধর্মকে বিক্রি করে নিজেদের জন্য গড়ে তুলছে সম্পদের পাহাড়।

এসব কারণে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ জনগণ গাফফার ভাইয়ের অনুপস্থিতি তিলে তিলে অনুভব করছেন। কদিন আগে মহর্ষী লালন শাহের একটি অতি জনপ্রিয় গানের দুটি লাইন লেখার কারণে সনাতনি ধর্মের এক লেখককে কারাবাস করতে হয়েছে। ধর্মান্ধ দানবের দল তার বাড়ি আক্রমণ করেছে। অথচ লালনের লেখা বহু বাউল গানের মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতার যে নিরঙ্কুশ বাণী রয়েছে, এ গানটি তার অন্যতম, যেটি হলো- ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।’ এ গান দ্বারা লালন বলেছেন, কোনো মানুষকে জাতের পরিচয় দিয়ে চিহ্নিত করা মহা পংকিলতা। লালন আরও লিখেছেন- ‘যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীর তবে হয় কি বিধান।’ এ লাইন দুটো লেখার কারণেই তাকে জেলে যেতে হয়েছে। এটি নাকি কারও কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। হায়রে ধর্মীয় অনুভূতি! যে সব পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে তারা নিশ্চিতভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন, কেননা এটি লেখার জন্য ৫৪ ধারায় গ্রেফতার আইনের খেলাপ। বেআইনি আটক আমাদের আইনে শাস্তিযোগ্য। তাছাড়া যেসব ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী সঞ্জয়কে আক্রমণ করার জন্য জড়ো হয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছিল, পুলিশ তাদের গ্রেফতার না করে তাদের ওপর আইন দ্বারা অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। তারা আক্রমণকারীদের গ্রেফতার না করে বরং ভুক্তভোগীকে গ্রেফতার করে শুধু বেআইনিই নয়, একটি চরম নিন্দনীয় কাজ করেছেন। আজ গাফফার ভাই জীবিত থাকলে এ ঘটনার প্রতিবাদে দুনিয়াভর তোলপাড় শুরু করতেন। অন্যান্য গানসহ এ অমর কবিতাটি লালনকে অনন্য উচ্চতায় স্থান করে দিয়েছে। গোটা বিশ্বে আজ তিনি মানবতার অন্যতম প্রতিভাবান দার্শনিক হিসেবে পরিচিত। বিদেশ থেকে বহু জ্ঞানপিপাসু লালনের দরগায় শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন। গাফফার ভাই যেমন কবিগুরুর কবিতা/গানের ভক্ত ছিলেন, তেমনি ভক্ত ছিলেন বাউল দর্শনের। তিনি লালন সাঁইজি, শাহ আবদুল করিম প্রমুখ বাউল কবিকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। তার দিন শুরু হতো রবীন্দ্রসংগীত শুনে, আর শেষ করতেন লালনের গান দিয়ে। যে গানটির দুটি লাইন লেখার জন্য শরিয়তপুরে সঞ্জয় রক্ষিতকে জেলে যেতে হয়েছে, গাফফার ভাই প্রতিদিনই সেই গানটি শুনতেন, আমাকে বলতেন সেই গানটি গাইতে। আশির দশকে ড. সফিউল্লাহ নামক লন্ডনে কর্তৃব্যরত জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা দেহত্যাগ করলে লন্ডনের মৌলভীগণ তার জানাজা পড়াতে অস্বীকার করেছিলেন; কারণ ড. সফিউল্লাহ প্রতিদিন সন্ধ্যায় তার বাড়িতে ধুপ জ্বেলে রবীন্দ্রসংগীত এবং কীর্তনের অনুষ্ঠান করতেন। তখন গাফফার ভাই-ই ড. সফিউল্লাহর জানাজা পড়িয়েছিলেন। ধর্মান্ধ মৌলভীদের সংকীর্ণ মানসিকতার প্রতিবাদ করেছিলেন।

বহুদিক বিবেচনায়ই গাফফার ভাই অনন্য। শুধু কাব্য প্রতিভাই নয়, মানবিক চিন্তা-চেতনায় আর একজন গাফফার চৌধুরীকে খুঁজে পাওয়া ভার। আজ দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী অপশক্তি, ধর্ম-ব্যবসায়ীদের দল যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তা দমন করার জন্য যে ধরনের ক্ষুরধার লেখনী প্রয়োজন, সেটির অভাব গাফফার ভাইয়ের মহা প্রস্থানের ক্ষণ থেকেই শুরু হয়েছে। এ বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এক অকুতোভয় সৈনিক। পঙ্গু স্ত্রী এবং চার সন্তান নিয়ে বিলেতে শুধু জীবিকা নির্বাহের জন্য তাকে কী ধরনের সংগ্রাম করতে হয়েছে, তা খুব কম মানুষই জানেন। এক সময় তাকে একটি মাছের দোকানে মাছ কাটার কাজ করতে হয়েছে। বিলেতের ইমিগ্রেশন আদালতগুলোতে তরজমাকারীর কাজ করতে হয়েছে, বিবিসি বাংলা বিভাগে বাহ্যিক ভাষ্যকার হিসেবে কাজ করে সংসার চালাতে হয়েছে। তারপরও তিনি কখনো কারও সঙ্গে আপোস করেননি। ক্ষমতাসীনরা বহু প্রলোভন দেখিয়ে তাকে দলভুক্ত করার চেষ্টা করেছে; কিন্তু বহু অনটন সত্ত্বেও তিনি লোভের কাছে পরাজিত হননি। তার দূরদৃষ্টি ছিল গ্রিক পূরাণের ফিনিক্স পাখির মতোই প্রখর। গোটা পৃথিবী জানার বহু আগেই তিনি তার গভীর দূরদৃষ্টি প্রয়োগ করে জানতে পেরেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক ছিল খুনি জিয়াউর রহমান এবং মোশতাক। ১৯৭৬ সালে তিনি লন্ডন থেকে ‘বাংলার ডাক’ নামে যে পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিলেন, গোটা বিশ্বে সেটি ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রথম মুখপত্র। সেই পত্রিকায় ১৯৭৬ সালেই গাফফার ভাই রাখঢাক না রেখেই লিখেছিলেন- বঙ্গবন্ধুকে জিয়া-মোশতাকই হত্যা করেছে পাকিস্তানি প্রভুদের নির্দেশে, বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানে পরিণত করার মানসে। ভয় বলে কোনো কথা গাফফার ভাইয়ের অভিধানে ছিল না। যা ন্যায়ভিত্তিক বলে গাফফার ভাই মনে করতেন, কোনো শক্তিই তাকে সে কথা প্রকাশ করা থেকে বিরত করতে পারত না। ২০০৪ সালে তিনি ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নামক নাটকে জিয়া-মোশতাকদ্বয়কে বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল রূপকার হিসেবে চিহ্নিত করে যা লিখেছিলেন এবং প্রদর্শন করেছিলেন জনগণ সেটি দেখেও নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, জিয়া-মোশতাকই বঙ্গবন্ধুর আসল খুনি।  মৃত্যুর ৬ মাস আগেই ডাক্তাররা তাকে বলে দিয়েছিলেন তিনি ৬ মাসের বেশি বাঁচবেন না। তা জেনেও তিনি সবাইকে বলতেন, তার বিদায়ের পর যেন অন্যরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং অসাম্প্রদায়িকতার ধারা অব্যাহত রাখার জন্য অবিশ্রান্তভাবে কাজ করে যায়, দেশে যেন তালেবানিতন্ত্র শিকড় গাড়তে না পারে। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন জীবন্ত জ্ঞানকোষ। অতীতের বহু কিছুর ওপর তার পরিচিতি ছিল অসাধারণ। প্রয়াণের আগ দিয়ে তার প্রবল ইচ্ছা ছিল আত্মজীবনী লেখার। শুরুও করেছিলেন। কিন্তু কঠোর নিয়তি আর তা হতে দেয়নি।  আজ তার দ্বিতীয় প্রয়াণ দিবসে অনেক কথাই মনে পড়ছে। তিনি অমরত্বের বরপুত্র হিসেবে সবার মনে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রেরণাদাতা হিসেবে। 

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গঠিত ‘আবদুল গাফফার চৌধুরী স্মৃতি সংসদের’ আহ্বায়ক

সর্বশেষ খবর