কবিগুরু আজ বেঁচে থাকলে প্রয়াত আবদুুল গাফ্ফার চৌধুরীকে নিয়ে লিখতে গেলে কবিতার ভাষায় কিঞ্চিত পরিবর্তন এনে, এমনটাই লিখতেন। এ ঘাত-প্রতিঘাতের পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তিনি সবার মনেই বিরাজ করছেন, তবে নীরবে নয়, বরং সরবে। জীবিতাবস্থায় তিনি যেমন সরব ছিলেন সব কুসংস্কার, অন্যায়, নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিরুদ্ধে, তার কোটি কোটি গুণগ্রাহী সেই সরব গাফফার ভাইকেই মনের গভীরে ধারণ করে আছেন। গাফফার ভাইয়ের সারা জীবনের অন্যতম ব্রত ছিল সাম্প্রদায়িকতার মূল উৎপাটন। তার প্রাথমিক শিক্ষা মাদরাসায় হয়েছিল বলে ধর্মান্ধদের চিহ্নিত করতে, তাদের পরিকল্পনা বুঝে নিতে গাফফার ভাইকে বেগ পেতে হতো না। মাদরাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে তিনি জানতেন কোনো ধর্মই বিভেদ আর হানাহানি সমর্থন করে না, বরং সম্প্রীতির বাণীই হচ্ছে সব ধর্মের মূল প্রতিপাদ্য। তিনি জানতেন আজ ওয়াজের নামে কিছু অর্থলোভী তথাকথিত হুজুর ধর্মের ভিত্তিতে বিভেদ, হিংসা, ঘৃণা, জিঘাংসা প্রসারের যে কথা বলে বেড়াচ্ছে, অর্থের বিনিময়ে তা কখনো ইসলাম ধর্মের কথা নয়। এরা ধর্মকে বিক্রি করে নিজেদের জন্য গড়ে তুলছে সম্পদের পাহাড়।
এসব কারণে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ জনগণ গাফফার ভাইয়ের অনুপস্থিতি তিলে তিলে অনুভব করছেন। কদিন আগে মহর্ষী লালন শাহের একটি অতি জনপ্রিয় গানের দুটি লাইন লেখার কারণে সনাতনি ধর্মের এক লেখককে কারাবাস করতে হয়েছে। ধর্মান্ধ দানবের দল তার বাড়ি আক্রমণ করেছে। অথচ লালনের লেখা বহু বাউল গানের মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতার যে নিরঙ্কুশ বাণী রয়েছে, এ গানটি তার অন্যতম, যেটি হলো- ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।’ এ গান দ্বারা লালন বলেছেন, কোনো মানুষকে জাতের পরিচয় দিয়ে চিহ্নিত করা মহা পংকিলতা। লালন আরও লিখেছেন- ‘যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীর তবে হয় কি বিধান।’ এ লাইন দুটো লেখার কারণেই তাকে জেলে যেতে হয়েছে। এটি নাকি কারও কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। হায়রে ধর্মীয় অনুভূতি! যে সব পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে তারা নিশ্চিতভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন, কেননা এটি লেখার জন্য ৫৪ ধারায় গ্রেফতার আইনের খেলাপ। বেআইনি আটক আমাদের আইনে শাস্তিযোগ্য। তাছাড়া যেসব ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী সঞ্জয়কে আক্রমণ করার জন্য জড়ো হয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছিল, পুলিশ তাদের গ্রেফতার না করে তাদের ওপর আইন দ্বারা অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। তারা আক্রমণকারীদের গ্রেফতার না করে বরং ভুক্তভোগীকে গ্রেফতার করে শুধু বেআইনিই নয়, একটি চরম নিন্দনীয় কাজ করেছেন। আজ গাফফার ভাই জীবিত থাকলে এ ঘটনার প্রতিবাদে দুনিয়াভর তোলপাড় শুরু করতেন। অন্যান্য গানসহ এ অমর কবিতাটি লালনকে অনন্য উচ্চতায় স্থান করে দিয়েছে। গোটা বিশ্বে আজ তিনি মানবতার অন্যতম প্রতিভাবান দার্শনিক হিসেবে পরিচিত। বিদেশ থেকে বহু জ্ঞানপিপাসু লালনের দরগায় শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন। গাফফার ভাই যেমন কবিগুরুর কবিতা/গানের ভক্ত ছিলেন, তেমনি ভক্ত ছিলেন বাউল দর্শনের। তিনি লালন সাঁইজি, শাহ আবদুল করিম প্রমুখ বাউল কবিকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। তার দিন শুরু হতো রবীন্দ্রসংগীত শুনে, আর শেষ করতেন লালনের গান দিয়ে। যে গানটির দুটি লাইন লেখার জন্য শরিয়তপুরে সঞ্জয় রক্ষিতকে জেলে যেতে হয়েছে, গাফফার ভাই প্রতিদিনই সেই গানটি শুনতেন, আমাকে বলতেন সেই গানটি গাইতে। আশির দশকে ড. সফিউল্লাহ নামক লন্ডনে কর্তৃব্যরত জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা দেহত্যাগ করলে লন্ডনের মৌলভীগণ তার জানাজা পড়াতে অস্বীকার করেছিলেন; কারণ ড. সফিউল্লাহ প্রতিদিন সন্ধ্যায় তার বাড়িতে ধুপ জ্বেলে রবীন্দ্রসংগীত এবং কীর্তনের অনুষ্ঠান করতেন। তখন গাফফার ভাই-ই ড. সফিউল্লাহর জানাজা পড়িয়েছিলেন। ধর্মান্ধ মৌলভীদের সংকীর্ণ মানসিকতার প্রতিবাদ করেছিলেন।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গঠিত ‘আবদুল গাফফার চৌধুরী স্মৃতি সংসদের’ আহ্বায়ক