বুধবার, ২৯ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

সুন্দরবনে পাওয়া গেল ৩৯ হরিণের মৃতদেহ

শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট

সুন্দরবনে পাওয়া গেল ৩৯ হরিণের মৃতদেহ

ঘূর্ণিঝড় রিমালের তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সুন্দরবন। টানা ৩৬ ঘণ্টা ধরে চলা এই ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী, গাছপালাসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সুন্দরবনে উদ্ধার হয়েছে ৩৯টি হরিণের মৃতদেহ। সুন্দরবনের বন, নদী-খাল ছাড়াও লোকালয়ের কাছে নদীতে ভেসে আসে এসব মৃত হরিণ। যা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বন্যপ্রাণীর মৃতদেহের সংখ্যা। ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডবে ওয়ারলেস ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যাওয়ায় খোদ বন বিভাগের কাছেও নেই উদ্ধার হওয়া মৃত বন্যপ্রাণীর পুরো তথ্য। তবে দুপুর পর্যন্ত বন বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে উদ্ধার করেছে ৩৯টি হরিণের মৃতদেহ। সেগুলোকে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। এ সময়ে আহত ১৭টি হরিণকে উদ্ধার করে চিকিৎসা শেষে বনে অবমুক্ত করা হয়। ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী প্রথম দিনে সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী এবং চর থেকে এসব হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। সময়ের অভাবে বনের অভ্যন্তরে তল্লাশি শুরু করতে পারেনি বন বিভাগ। এবারের ঝড়ে বাঘ, হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর শাবক বেশি মারা গেছে। মাছ আহরণে বঙ্গোপসাগরে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকায় সাগরে মারা যাওয়া বাঘ- হরিণসহ সব বন্যপ্রাণীর মৃতদেহ কখনোই উদ্ধার করা সম্ভব হবে না বলে বন বিভাগ নিশ্চিত করেছে।

খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমাল এ-যাবৎকালে সুন্দরবনে আঘাত হানা ঝড়ের মধ্যে ব্যতিক্রমধর্মী। প্রায় ৩৬ ঘণ্টা ধরে সুন্দরবনের ওপর এ ঝড়টি তান্ডব চালায়। ভাটার সময়ে সুন্দরবনের অভ্যন্তরের পানি সমুদ্রে নেমে গেছে। আগের ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও উঁচু মাত্রার জোয়ারের পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পানি নেমে যায়। তবে এবার রিমালের বেলায় তার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। টানা ৩৬ ঘণ্টা ধরে ডুবে ছিল সুন্দরবন। দীর্ঘ সময় সুন্দরবন জলমগ্ন থাকায় বন্যপ্রাণীর হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। আমাদের আশঙ্কা এবারের ঝড়ে বাঘ, হরিণসহ অন্য বন্যপ্রাণীর শাবক বেশি মারা গেছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩৯টি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে আরও ১৭টি হরিণ। বন বিভাগের লোকজন আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হরিণগুলোকে সেবা  শুশ্রƒষার পর বনে অবমুক্ত করেছে। নদী ও চর থেকে এসব হরিণ উদ্ধার করা হলেও সময়ের অভাবে বনের ভিতরে তল্লাশি চালানো সম্ভব হয়নি। অনেক বন্যপ্রাণীকে ভেসে যেতে দেখেও প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে বনরক্ষীরা কিছু করতে পারেননি। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকা ও ওয়ারলেস সিস্টেম বিনষ্ট হওয়ায় উদ্ধারের সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। তবে এটাও ঠিক সমুদ্রে ভেসে যাওয়া ও গহিন অরণ্যে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকায় বেশির ভাগ মৃত বন্যপ্রাণীর সঠিক তথ্য কখনোই পাওয়া যাবে না। সিএফ আরও বলেন, এই ঝড়ে প্রাথমিকভাবে সুন্দরবনের অবকাঠামোগত যে ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা। যদিও বন্যপ্রাণী এবং সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরীসহ অন্যান্য গাছপালার কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সেটি এখনো নিরূপণ করা হয়নি। ঝড়ে বিশেষ করে সুন্দরবনের কটকা, কচিখালী, দুবলা, কোকিলমনি, বুড়িগোয়ালিনী, নীলকমল ও মান্দারবাড়িয়া ফরেস্ট ক্যাম্পের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবনকে সুরক্ষায় এখন দীর্ঘমেয়াদি ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানান এই শীর্ষ বন কর্মকর্তা।

রিমালে শত শত বাঘ-হরিণ ভেসে গিয়ে মারা যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করে সুন্দরবন নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, উঁচু মাত্রার জোয়ারের স্রোতের তোড় বা জলোচ্ছ্বাসে বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণীরা টানা ছয় থেকে আট ঘণ্টা টিকে থাকতে পারে। আগের সুন্দরবনে আঘাত হানা প্রতিটি ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এবার একটানা ৩৬ ঘণ্টা ধরে চলা ঘূর্ণিঝড়ে চরম বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে বাঘ, হরিণসহ অসংখ্য বন্যপ্রাণী। প্রাপ্তবয়স্ক বাঘ ও বানর গাছে চড়তে পারে। তবে বাঘ শাবকসহ হাজার-হাজার হরিণ স্রোতের তোড়ে ভেসে গিয়ে মারা পড়েছে। সুন্দরবনের মিঠাপনির উৎস ১১৫টি পুকুর ৮ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায়। ওইসব পুকুরপাড়ে আশ্রয় নিয়েও বন্যপ্রাণীরা রক্ষা পায়নি। শুধু ১০টি নয়, ১৫ ফুট উঁচু আরও অন্তত ২০০টি মাটির টিলা দ্রুত তৈরি করে বাঘ-হরিণসহ সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীদের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে রক্ষার দাবি জানান এই গবেষক। 

বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মোহাম্মদ নূরুল করিম জানান, এখনো ঘূর্ণিঝড় রিমালের তান্ডবে সুন্দরবনের গাছপালাসহ কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণ হওয়া যায়নি। পূর্ব বন বিভাগের বিভিন্ন বন অফিস, টহল ফাঁড়িসহ টহল বোট, টিনের চালা, জানালা, সোলার প্যানেল, ওয়ারলেস সিস্টেম এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রিমালের কবলে পড়ে দুবলা, কটকা অভয়াণ্যে অফিস ঘাটের জেটি এবং পুকুর বঙ্গোপসাগর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দুবলা, কটকা, কচিখালি, বগিসহ বিভিন্ন বন অফিস এবং টহল ফাঁড়ির রান্নাঘরের চালা উড়ে যায়। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে মিঠাপানির পুকুরগুলোও জলোচ্ছ্বাসে লোনা পানিতে তলিয়ে গেছে। একমাত্র মিঠাপানির উৎস সব পুকুর ৮ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে লোনা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বন কর্মীদের পাশাপাশি বন্যপ্রাণীরাও সুপেয় পানির সংকটে পড়েছে। সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীরা অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়ে মারা যাওয়ারও খবর মিলেছে। এখনো সব অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত না হওয়ায় সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য জানা যায়নি।

সর্বশেষ খবর