বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

বিশ্বে শান্তি এখন আগের চেয়ে কঠিন : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিশ্বে শান্তি এখন আগের চেয়ে কঠিন : প্রধানমন্ত্রী

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস উপলক্ষে গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা -পিআইডি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বে শান্তি নিশ্চিত করা এখন আগের চেয়ে অনেক কঠিন। বর্তমানে প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে বাড়ছে নতুন নতুন হুমকি। ফলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনগুলোর শান্তিরক্ষীদের বহুমাত্রিক জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

গতকাল সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস-২০২৪’ উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুয়েন লুইস।

প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আহত তিনজনের হাতে সম্মাননা তুলে দেন। তিনি ইউএন পিস কিপার্স জার্নালের (দশম ভলিউম) মোড়কও উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মত্যাগকারী বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের কৃতিত্বের ওপর একটি ভিডিও প্রামাণ্যচিত্র  প্রদর্শন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী পরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে কর্মরত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি বৈশি^ক শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় একটি দায়িত্বশীল ও নির্ভরযোগ্য নাম। আমরা সর্বজনস্বীকৃত এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, জাতির পিতার পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতার অঙ্গীকার ও আমাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ‘ব্লু হেলমেট’ পরিবারের সদস্য হয়। সরকারপ্রধান বলেন, বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ১৩টি স্থানে ৪৯৩ নারীসহ ৬ হাজার ৯২ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা যেখানে কাজ করছেন সেসব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা তাদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। প্রশংসা শুনে গর্বে আমার বুকটা ভরে যায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ৩৬ বছর উদযাপন করছি। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বৃহৎ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ এবং সবাই অত্যন্ত সুনাম ও গৌরবের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। জাতির পিতার আদর্শ অনুসরণ করে আমরা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছি। শান্তিরক্ষা মিশন ছাড়াও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতেও আমরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও অবদান রাখছি। জাতির পিতা নিজেকে বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত ও নির্যাতিত মানুষের দূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘জাতির পিতা বলতেন-বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত, শোষক ও শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে।’ তাই সব সময় তিনি শোষিত মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা রোধ, সাম্য-মৈত্রী, গণতন্ত্র রক্ষা এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘বিশ্বশান্তি পরিষদ’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৩ সালের ২৩ মে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে। জাতির পিতা সেই পদক উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী বীর শহীদ এবং সেনানীদের। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দ্বন্দ্ব সংঘাত, যুদ্ধ আজ বিশ্বশান্তি বিঘিœত করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু। সেখানে গণহত্যা চলছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা ইত্যাদি মানবজাতির জন্য এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, আমি ঠিক জানি না এই সংঘাত বা যুদ্ধ মানবজাতির জন্য কী কল্যাণ বয়ে আনছে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা প্রতিনিয়ত যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততই মানুষের জীবন আরও বেশি দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে নারী-শিশুরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে। যুবকরা অকাতরে জীবন দিচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সবকিছু সমাধান করতে চাই। তিনি বলেন, বিশ্বে এখনো বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। কোটি কোটি মানুষ দুবেলা খাবার পায় না। রোগের চিকিৎসা পায় না। শিশুরা শিক্ষা পায় না। তারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। যারা অস্ত্র তৈরি এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতায় এত অর্থ ব্যয় করছে তাদের কাছে আমার আহ্বান-আমরা শান্তির কথা বলি, কিন্তু সংঘাতে লিপ্ত হই কেন? সরকারপ্রধান বলেন, ‘এই যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে, এই অর্থ যদি ক্ষুধার্ত মানুষের আহারের ব্যবস্থা, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থায় ব্যয় হতো তাহলে এই পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতো। মানুষের জীবনমান উন্নত হতো। মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচতে পারত। কিন্তু এই সংঘাত প্রতিনিয়ত মানুষকে আরও কষ্টের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কাজেই আমি সব সময় যেখানেই যাই এ একটি আহ্বানই জানাই- সংঘাত নয়, যদি কোনো সমস্যা থাকে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার। সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ।’ তিনি আরও বলেন, সেই সঙ্গে এই অস্ত্র তৈরি আর প্রতিযোগিতার অর্থ যেসব দেশ এখনো জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে সেই জলবায়ুর অভিঘাত থেকে মানবজাতিকে রক্ষার জন্য সেই তহবিলে সেই অর্থ দিতে পারেন। তাছাড়া ক্ষুধার্ত ও শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ব্যবহার করতে পারেন। সেই আহ্বান আজকে আমি সবাইকে জানিয়ে যাচ্ছি। শেখ হাসিনা বলেন, নারীর অধিকার এবং লিঙ্গ সমতা নিশ্চিতে সরকারের পদক্ষেপ ‘উইমেন পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি এজেন্ডা’ তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বর্তমানে অন্যতম বৃহৎ নারী শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবেও পরিচিতি লাভ করছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বমাট ৩ হাজার ৩৮ জন নারী শান্তিরক্ষী সফলতার সঙ্গে মিশন সম্পন্ন করেছেন। এজন্য আরও অধিক পরিমাণে নারী শান্তিরক্ষী প্রেরণেরও দাবি উঠেছে। তিনি দি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস’-এর আহ্বানে একাত্মতা ঘোষণা করে দারিদ্র্যের অবসান, পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষা এবং জনগণের শান্তি ও সম্প্রীতি নিশ্চিতকল্পে বাংলাদেশে নিয়োজিত জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করেন।

দেশব্যাপী কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা এবং সেখান থেকে জনগণকে ৩০ প্রকারের ওষুধ বিনামূল্যে প্রদানে সরকারের পদক্ষেপের উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকের অনুকরণে সম্প্রতি সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সহায়তায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সে দেশের প্রেসিডেন্টের নামে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। সেজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে তিনি ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিশন এলাকার পরিবেশ, আবহাওয়া এবং ভূমির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নত প্রযুক্তির সামরিক সরঞ্জামাদি ও পোশাকসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশ কন্টিনজেন্ট সমূহে অত্যাধুনিক ‘মাইন রেসিস্ট্যান্ট অ্যামবুশ প্রটেকটেড’ যানবাহন এবং শান্তিরক্ষীদের যোগাযোগের জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করেছি।

রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছেন আজ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব এম এম ইমরুল কায়েস বিকালে জানান, প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় হেলিকপ্টারযোগে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার উদ্দেশে রওনা হবেন। সেখানে সরকারি মোজহার উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ মাঠে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করবেন। প্রধানমন্ত্রীর পটুয়াখালী সফরকে ঘিরে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে।

সর্বশেষ খবর