শুক্রবার, ৩১ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

লাশের টুকরোতে সব রহস্য

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা ও কলকাতা প্রতিনিধি

লাশের টুকরোতে সব রহস্য

‘ওয়াটার থিওরি’ অনুসরণ করেই মাংসের টুকরোর হদিস পায় গোয়েন্দারা। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আনার খুনে জড়িত ঢাকায় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আক্তারুজ্জামান শাহিনের গার্লফ্রেন্ড শিলাস্তি রহমানের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। তিনি বলেছিলেন, ঘটনার সময় ওপর থেকে পানির অনেক শব্দ শুনেছেন। পানির শব্দ আসছিল টয়লেট থেকে। গোয়েন্দারা তার এই তথ্যটিকে গুরুত্ব দেয়। এরপর ঢাকার গোয়েন্দা দল পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করেই কলকাতা সিআইডিকে অনুরোধ করে কমোড, সেপটিক ট্যাংক, সুয়ারেজ লাইন পরীক্ষা করতে। এরপর সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয় কয়েক কেজি মাংস। গোয়েন্দাদের ভাষায়- এই ওয়াটার থিওরি প্রয়োগ করেই লাশের টুকরো মিলেছে। গোয়েন্দারা মনে করছে, লাশের টুকরো খুঁজে পাওয়ার মধ্য দিয়েই তদন্ত এগিয়ে গেছে অনেক দূর।

এদিকে আনোয়ারুল আজিম হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে যাকে সন্দেহ করা হচ্ছে, সেই মো. আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহিনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত আনতে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বন্দিবিনিময় চুক্তি থাকায় এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নিজস্ব প্রক্রিয়ায়ও আক্তারুজ্জামানকে দেশে ফেরত আনতে চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।

গতকাল বিকাল ৪টায় কলকাতা থেকে একটি ফ্লাইটে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা (ডিবি) শাখার প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, কলকাতায় আমাদের তদন্তকাজ শতভাগ সফল হয়েছে। সাক্ষ্যপ্রমাণ আর ইলেকট্রনিক ডিভাইসের আলামতসহ সব মিলিয়ে এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যা মামলা কনক্লুসিভ পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কলকাতায় উদ্ধার হওয়া খন্ডিত মাংস ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের। তবে ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে পেলে নিশ্চিত হতে পারব। তিনি বলেন, এমপি আজিমের হত্যার মোটিভ সংগ্রহে কাজ হয়েছে। তিনি নতুন কোনো ব্যবসার উদ্দেশে ভারত গিয়েছিলেন কি না সেটি নিয়েও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তার হত্যার পেছনে এলাকার রাজনীতি কতটুকু প্রভাব রেখেছে সেগুলোও আমাদের কাছে বিবেচ্য।

এর আগে কলকাতা বিমানবন্দরে ডিবিপ্রধান হারুন সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিকভাবে সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার হওয়া এই মাংস এমপি আনারের মনে করা হলেও এ ব্যাপারে ১০০ শতাংশ নিশ্চিত হতে ফরেনসিক এবং ডিএনএ টেস্ট জরুরি।’ আনুষ্ঠানিকভাবে সিআইডিকে চিঠি দিয়ে এখানকার লাশের টুকরো নিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হবে বলেও এদিন জানান ডিবিপ্রধান। উদ্ধারকৃত এই মাংস এমপি আনারের লাশের টুকরো কি না, তা পরীক্ষার জন্য ইতোমধ্যেই সেই নমুনা পাঠানো হয়েছে ‘সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি’তে। প্রয়োজনে করা হবে ডিএনএ টেস্টও। সে ক্ষেত্রে কলকাতায় ডাকা হতে পারে এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফিরদৌস ডোরিনকে। হারুন বলেন, ‘আমরা সিআইডিকে অনুরোধ জানিয়েছি এই পরীক্ষাগুলো যেন খুব দ্রুততার সঙ্গে করা হয়।’ ডিএনএ টেস্ট করার জন্য এমপি আনারের মেয়ে ডোরিন খুব শিগগিরই কলকাতা আসবেন। ভারতে আসার জন্য সম্ভবত তিনি ভিসাও পেয়ে গেছেন।’ তিনি বলেন, আমরা তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে কলকাতায় এসেছিলাম। আমরা যে মূল ঘাতককে গ্রেফতার করেছি, তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য আমরা মিলিয়ে নেওয়ার কাজ করেছি কলকাতায়। দ্বিতীয়ত, ভারতে গ্রেফতার জিহাদের সঙ্গে আমাদের কাছে থাকা মূল ঘাতকের কথা মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। এতে শতভাগ মিলেছে। ডিবিপ্রধান বলেন, আমাদের আরও একটি বিষয় ছিল- সেটি হলো স্বচক্ষে ডিজিটাল এভিডেন্সগুলো মিলিয়ে দেখা। এমপি যার বাসায় ছিলেন, সেই গোপাল বাবুর সঙ্গেও আমরা কথা বলেছি। আমরা সিআইডিকে বলেছিলাম সেপটিক ট্যাংক ও কমোড ভেঙে দেখার জন্য। আমাদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সিআইডি কিন্তু সেপটিক ট্যাংক থেকে ভিকটিমের দেহের অনেক খন্ডাংশ পেয়েছে। আমরা যে যে উদ্দেশ্য নিয়ে কলকাতায় এসেছিলাম, তার শতভাগ সফলতা নিয়ে আমরা বাংলাদেশে ফিরছি। আরও ভালো খবর আপনারা পাবেন। বাংলাদেশের দুষ্কৃতকারীরা পশ্চিমবঙ্গকে কি একটি সেফজোন মনে করছে- এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, এবার কলকাতা আসার পর এখানকার পুলিশের সঙ্গে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এতে করে বলতে পারি, বাংলাদেশ থেকে কেউ অপরাধ করে এসে কলকাতাকে স্বর্গীয় ভবন মনে করতে পারবে না। আমরা আগামীতে তাদের আরও দ্রুত সময়ে কলকাতা থেকে ধরে নিয়ে যেতে পারব। পলাতক আসামিদের প্রসঙ্গে ডিবিপ্রধান বলেন, আরেকজন আসামি রয়েছে কাঠমা ুতে। আরেকজন আসামি রয়েছে আমেরিকায়। অভিযুক্ত সিয়ামের তথ্য চেয়ে আমরা ইতোমধ্যে নেপালকে জানিয়েছি। এ ঘটনা মূল অভিযুক্ত শাহিন এখন যুক্তরাষ্ট্রে আছে। আমরা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে বলেছি, যেহেতু এখানে একটি মামলা হয়েছে, শাহিন এ ঘটনার মূল অভিযুক্ত। তাকে যেন ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে মানববন্ধন : ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, ঝিনাইদহ-৪ আসনের আনোয়ারুল আজিম আনারের দেহাংশ শনাক্ত করতে তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডোরিন ও ভাই আবেদ আলীকে কলকাতায় যেতে হতে পারে। গত বুধবার রাত ১১টার দিকে এমপিকন্যার মোবাইলে ডিবির পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি জানানো হয়। তবে কলকাতার নিরাপত্তার বিষয়টি তাকে চিন্তিত করছে। এমপির ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রউফ বলেন, গত মঙ্গলবার কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীভা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটের সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে এমপির দেহের খি তাংশ উদ্ধার করা হয়েছে। দেহাংশ নিশ্চিত করতে তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডোরিন ও ভাই আবেদ আলীকে কলকাতায় ডেকেছিল ডিবি পুলিশের প্রধান হারুন অর রশিদ। কিন্তু ডিবি পুলিশের প্রধান বাংলাদেশে চলে আসার কারণে কলকাতায় কবে যেতে পারব সেটি নিশ্চিত হতে পারছি না। এদিকে নিরাপত্তার বিষয়ে এমপিকন্যা ডোরিন বলেন, ভারতীয় ভিসা এখনো পর্যন্ত পায়নি এবং কলকাতা থেকে কেউ আমাদের কিছুই বলেননি। আর সেখানে আমাদের নিরাপত্তা দেবে কারা। সবদিক বিবেচনা করে শুক্রবার ঢাকায় যেতে পারি। সেখান থেকে যে পরামর্শ দেবে সেই পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করব।

এমপি আনার হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে ব্যবসায়ীদের মানববন্ধন : আনার হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। এরই অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার দুপুরে কালীগঞ্জ শহরে বাজার ব্যবসায়ী সমিতির উদ্যোগে এক মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম আশরাফ, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন সোহেল, নিহত এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডোরিন, বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আসাদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক ইন্তা, সাংগঠনিক সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বিপ্লবসহ স্থানীয় বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা। এ ছাড়া মানববন্ধনে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির কালীগঞ্জ উপজেলা শাখার সদস্যরা অংশ নেন। মানববন্ধনে উপস্থিত ব্যবসায়ী নেতারা এমপি আনার হত্যাকারীদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শস্তির দাবি জানান।

সর্বশেষ খবর