শনিবার, ১ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

বন্ধ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার

বাংলাদেশসহ সোর্স কান্ট্রি ১৪ দেশের জন্যই স্থগিত ♦ শেষ মুহূর্তে বিমানবন্দরে হাজারো কর্মী ♦ ফ্লাইট জটিলতায় যাওয়া হলো না ৩১ হাজারের

বিশেষ প্রতিনিধি

বন্ধ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া কর্মী নেওয়া বন্ধ করেছে। আপাতত সব সোর্স কান্ট্রি থেকেই কর্মী নেওয়া স্থগিত করেছে দেশটি। ফলে গতকাল রাত ১২টার পর থেকে বাংলাদেশসহ ১৪ দেশের জন্য বন্ধ হয়েছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। গতকাল শেষ মুহূর্তে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য উপচে পড়া ভিড় ছিল ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে। কিন্তু ভিসা পেয়ে, কয়েক লাখ টাকা খরচ করেও মালয়েশিয়া যেতে পারেনি প্রায় ৩১ হাজার বাংলাদেশি। শেষ মুহূর্তে বেশ কয়েকটি বিশেষ ফ্লাইট আয়োজন করেও এ বিশালসংখ্যক ভিসাপ্রাপ্ত কর্মীকে পাঠানো যায়নি। ঋণ করে টাকা দিয়ে নিঃস্ব এসব কর্মী হাহাকার করেছে বিমানবন্দরে। গত দেড় বছরে প্রায় ৫ লাখ কর্মী যাওয়া মালয়েশিয়ার রাস্তা বন্ধ হওয়ায় বড় ধাক্কা খেল বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, দীর্ঘ চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে নানা প্রচেষ্টায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু করা হয়। এরপর মালয়েশিয়া থেকে পাওয়া চাহিদাপত্রের বিপরীতে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৪৬ কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেয়। গত মার্চে মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, আপাতত আর শ্রমিক নেওয়া হবে না। আর অনুমোদন ও ভিসা পাওয়াদের ৩১ মে’র মধ্যে মালয়েশিয়ায় ঢুকতে হবে। সর্বশেষ মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ জানায়, ঢাকা থেকে গতকাল (৩১ মে) রাত ১২টার আগে পর্যন্ত ছেড়ে যাওয়া ফ্লাইটের যাত্রীদেরই কর্মী হিসেবে গ্রহণ করা হবে। রাত ১২টার পর ছেড়ে যাওয়া আর কোনো ফ্লাইটকে অনুমোদন দেওয়া হবে না। রাত ১২টা পর্যন্ত মালয়েশিয়া যেতে পেরেছে ৪ লাখ ৯৪ হাজার ১০২ জন। সে হিসেবে মালয়েশিয়া যেতে পারেনি ৩০ হাজার ৮৪৪ জন ভিসা ও অনুমোদন পাওয়া বাংলাদেশি কর্মী। গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, শেষ দিনে মালয়েশিয়া যেতে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিড় করেছে হাজারো শ্রমিক। অনেকেই চার-পাঁচ দিন ধরে বিমানবন্দরে অবস্থান করছে। এজেন্সিগুলো আশ্বাস দিলেও মিলছে না ফ্লাইটের টিকিট। নাটোর থেকে আসা হাবিবুর রহমান নামে এক মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু বলেন, ‘পাঁচ দিন থেকে বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছি। কিন্তু বিমানের কোনো টিকিট পাচ্ছি না। এজেন্সি থেকে বলছে তারা চেষ্টা করছে, টিকিটের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। টিকিটের মূল্য ৪০ হাজার টাকা হলেও তারা প্রথমে ৮০ হাজার টাকা নিয়েছে। তখন বলেছিল টিকিটের দাম বেড়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার এজেন্সি থেকে বলা হয়, একটা টিকিট পাওয়া গেছে। এজন্য অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা দাবি করে তারা। এলাকা থেকে ঋণ করে এনে সেই অতিরিক্ত টাকা দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো টিকিট পাইনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় এক ইলেকট্রিক কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছি। ভিসাও এসেছে ২০ দিন আগে। এর পর থেকে টিকিটের জন্য এজেন্সিকে তাড়া দিয়ে আসছি। এখন পর্যন্ত তারা আমার কাছ থেকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা নিয়েছে। জমি, গরু ও বউয়ের গয়না বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেছি। সর্বশেষ টিকিটের জন্য অতিরিক্ত টাকা ঋণ করে আনতে হয়েছে। এখন যদি আমি যেতে না পারি তাহলে পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।’ মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা রুবেল হোসেন নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘এজেন্সিকে টাকা দিয়ে বিপদে পড়েছি। ভিসা এসেছে প্রায় এক মাস আগে। এর পর থেকে টিকিটের জন্য চেষ্টা করছি। কিন্তু তারা টিকিটের জন্য বারবার ঘোরাচ্ছে। এখন তারা বলছে এক সপ্তাহ পর আবার মালয়েশিয়ার বিমান চালু হবে। তখন টিকিট দিতে পারবে।’ মাদারীপুর থেকে আসা আকবর আলী নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘আট-দশ দিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি, কিন্তু কোনো টিকিট পাইনি। টিকিটের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে সব টাকা শেষ হয়ে গেছে। টাকার অভাবে গতরাতে বিমানবন্দরেই ঘুমিয়েছি। আমার কাছে আর মাত্র ৪০ হাজার টাকা আছে। এখন টিকিটের জন্য এজেন্সি দেড় লাখ টাকা চাইছে। এত টাকা আমি কোথায় পাব? সময়মতো টিকিট না পাওয়ায় এখন আর মালয়েশিয়া যেতে পারব কি না জানি না।’ রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার চালু হওয়ার পর থেকে বিমানের টিকিট নিয়ে চলছিল হরিলুট। সর্বশেষ মার্চে মালয়েশিয়ায় ৩১ মে’র মধ্যে ঢোকার ঘোষণা আসার পর থেকে ছাড়িয়ে যায় সব সীমা। ২০ হাজার টাকার টিকিটে ১ লাখ টাকার বেশি দামে বিক্রি হয়। শেষে আর পাওয়াও যায়নি। সর্বশেষ এক সপ্তাহ চেষ্টা করেও কোনো বিমানেরই টিকিট পাওয়া যায়নি। সরকারের পক্ষ থেকে শেষ দিনে বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এক মাস আগে থেকে এ ব্যবস্থা থাকলে এতসংখ্যক কর্মীকে হতভাগ্য হয়ে ফিরতে হতো না। অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে হতো না কর্মী বা এজেন্সিকে। জানা যায়, বাংলাদেশের অন্যতম আগ্রহের মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ২০০৯ সালে প্রথম দফায় বন্ধ হয়েছিল। এরপর ২০১৬ সালের শেষে চালু হয় শ্রমবাজার। পরে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে আবার বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। সেই শ্রমবাজার আবার চালু হয় ২০২২ সালে। এখন আবার কর্মী নেওয়া স্থগিত করল দেশটি। শ্রমবাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালয়েশিয়া সরকার নতুন কোটা বরাদ্দ করে বাংলাদেশসহ সব সোর্স কান্ট্রি থেকে আবার কর্মী নেওয়া শুরু করবে ২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে।

সর্বশেষ খবর