রবিবার, ২ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা
মালয়েশিয়া যেতে না পারা কর্মীদের দীর্ঘশ্বাস

মনঃকষ্টে আত্মহত্যার চেষ্টা!

ভৈরবে ট্রেন থেকে মেঘনায় ঝাঁপ দিয়ে নিখোঁজ যুবক, আটকে যাওয়াদের পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বললেন প্রতিমন্ত্রী ও হাইকমিশনার

নিজস্ব প্রতিবেদক

মনঃকষ্টে আত্মহত্যার চেষ্টা!

বিমানবন্দরে গতকাল মালয়েশিয়া যাওয়ার বৈধ কাগজপত্র দেখাচ্ছেন এক কর্মী -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার আমির উদ্দিনের ছেলে সোহেল তানভীর (২১) ঢাকা এসেছিলেন মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে। সে দেশের শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার শেষ দিনে তার ফ্লাইট ছিল। কিন্তু এজেন্সি জানায়, তার ফ্লাইট পিছিয়েছে। মনঃকষ্ট নিয়ে আন্তনগর উপকূল ট্রেনে বাবা-ছেলে বাড়ি ফিরছিলেন একসঙ্গেই। ট্রেন কিশোরগঞ্জের ভৈরববাজার জংশনে বিরতি দেওয়ার পর সিট থেকে উঠে দরজায় দাঁড়ান সোহেল। একটু পরই ট্রেনটি মেঘনা রেলসেতু অতিক্রমের সময় তাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায় নদীতে। অনেক খুঁজে দুই দিনেও নদীতে পাওয়া যায়নি তার লাশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানসিক যন্ত্রণায় আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকতে পারেন সোহেল। সোহেলের বাবা আমির উদ্দিন মেরাজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এমন দুঃখজনক ঘটনা আমার জীবনে ঘটবে কখনো ভাবতে পারিনি। সংসারের সুখের জন্য একমাত্র ছেলেকে মালয়েশিয়া পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এখন ছেলেকেই হারালাম।’ জানা যায়, ভিসা পাওয়ার পরও প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশি মালয়েশিয়া যেতে না পেরে হতাশ। ইতোমধ্যে জমি বিক্রি, ঋণ করে জনপ্রতি ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা বিভিন্ন দালালের হাতে তুলে দেওয়া এসব পরিবার এখন দিশাহারা। গতকালও বেশ কয়েকজনকে দেখা গেছে বিমানবন্দরে বসে থাকতে। আর বেশির ভাগই টাকা ফেরতের জন্য ধরনা দিয়েছেন দালাল ও এজেন্সিগুলোর অফিসে। গতকাল প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, ফ্লাইট জটিলতায় আটকে যাওয়া বাংলাদেশিদের মালয়েশিয়ায় পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় একই চেষ্টার কথা জানিয়েছেন সে দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার শামীম আহসান।

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিখোঁজ থাকা সোহেল তানভীরের প্রতিবেশী তানজীব জামান জানান, আমির উদ্দিন মেরাজের এক ছেলে ও এক মেয়ে। সংসারে সচ্ছলতা আনতে ছেলে সোহেল তানভীরকে মালয়েশিয়া পাঠাতে চেয়েছিলেন। মালয়েশিয়ার যাত্রা বাতিল হওয়ায় সোহেল মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে থাকতে পারেন। এ ঘটনার পর তাদের পরিবারসহ এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন পরিবারের সদস্যরা। বাবা আমির উদ্দিন মেরাজ জানান, ছেলে সোহেল ভিসা পেয়ে শুক্রবার বিমানযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা ছিল। সে অনুযায়ী সকালে তিনি ছেলেকে নিয়ে বিমানবন্দরে যান। কিন্তু বিমানের যাত্রা বাতিল হওয়ায় ছেলেকে নিয়ে বিকালে আন্তনগর উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। ট্রেনের ‘ট’ বগিতে ১১ ও ১২ নম্বর সিটে বসে আখাউড়ায় নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন বাবা-ছেলে। ট্রেনটি বিকাল ৫টার দিকে ভৈরব রেলওয়ে জংশনে যাত্রাবিরতি দেয়। সেখান থেকে ছেড়ে মেঘনা নদীর ওপর রেলসেতুতে পৌঁছালে সোহেল হঠাৎ নদীতে পড়ে যায়। এর আগে সোহেল সিট থেকে উঠে ট্রেনের দরজায় দাঁড়ানো ছিল বলে তার বাবা জানান। কিন্তু কীভাবে ট্রেনের দরজা থেকে নদীতে পড়ে গেল, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। আশুগঞ্জ রেলস্টেশনে নেমে আমির উদ্দিন ঘটনাটি ভৈরব রেলওয়ে থানা পুলিশকে অবহিত করেন। ভৈরব নৌপুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা চেষ্টা করেও তার খোঁজ পাননি। ভৈরব রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আলিম শিকদার জানান, নিখোঁজ যুবকের বাবা শুক্রবার সন্ধ্যায় ঘটনাটি থানায় এসে আমাকে অবহিত করলে আমি নৌপুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকে ঘটনাটি অবহিত করি। তারা উদ্ধারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ভৈরব নৌ থানার অফিসার ইনচার্জ মনিরুজ্জামান চৌধুরী জানান, রেলওয়ে থানা পুলিশ ঘটনাটি আমাকে অবহিত করলে স্থানীয় ফায়ারকর্মীদের নিয়ে শুক্রবার রাত ৮টা পর্যন্ত নদীতে খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাইনি। মেঘনায় প্রচুর স্রোত। যদি সে পানিতে ডুবে মারা যায়, তবে লাশ দু-তিন পর ভেসে উঠতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি।

গতকাল সকাল থেকে আবারও পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল নদীতে তল্লাশি চালায়। স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ইনচার্জ আক্কাছ আলী বলেন, ‘শুক্রবার রাত ৮টা পর্যন্ত এবং আজ (শনিবার) সকাল থেকেই নদীতে তল্লাশি চালাই। কিন্তু তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।’

কর্মী প্রেরণ করতে না পারা খুবই দুঃখজনক-প্রতিমন্ত্রী : সিলেট থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ করতে না পারা খুবই দুঃখজনক। মালয়েশিয়ায় ৫ লাখের বেশি কর্মী প্রেরণের জন্য সে দেশের সরকার সুযোগ দিয়ছিল। সেই কোটা পূরণে কাজ করেছিল বাংলাদেশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে রিক্রুটিং এজেন্টদের সংগঠন বায়রার সঙ্গে কথা বলে কাদের ভিসা হয়েছে আর কাদের ভিসা হয়নি সে তথ্য চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বায়রা সে তালিকা দিতে পারেনি। ফলে ফ্লাইটের সমস্যা হয়েছে। পরে কর্মী পাঠানোর জন্য ২২টি বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়। একই সঙ্গে মালয়েশিয়া সরকারকে সময় বাড়ানোর জন্যও চিঠি দেওয়া হয়। তবে এখনো সে চিঠির উত্তর আসেনি বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, এ সমস্যা সমাধানে এম্বাসি ও মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। সরকার চায় বৈধপথে শ্রমিক বিদেশে যাবে, বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাবে। আমাদের উদ্দেশ্য হয়রানি করা নয়, যারা হয়রানি করছে তাদের ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। গতকাল দুপুরে সিলেটে সরকারি আলিয়া মাদরাসা পরিদর্শন ও মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

দ্রুত মালয়েশিয়া নেওয়ার চেষ্টা চলছে-হাইকমিশনার : মালয়েশিয়া প্রতিনিধি জানান, ভিসা পেয়েও যারা মালয়েশিয়া যেতে পারছেন না, তাদের দ্রুত নেওয়ার ব্যাপারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. শামীম আহসান। শুক্রবার রাতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর পরিদর্শন করেন মো. শামীম আহসান। হাইকমিশনার বলেন, ৫ লাখ ২৭ হাজারের বেশি ডিমান্ড লেটার সত্যায়ন করেছে হাইকমিশন। এ পর্যন্ত ৪ লাখ ৭২ হাজারের বেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় এসেছে। আমরা নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, তারা (বাংলাদেশি বাকি কর্মী) যেন প্রতিশ্রুত কাজে যোগদান করতে পারেন। বিভিন্ন জটিলতায় হয়তো তারা আসতে পারছেন না। কিন্তু আমাদের প্রচেষ্টা চলমান আছে। তার সঙ্গে থাকা প্রথম সচিব প্রেস সুফি আবদুল্লাহিল মারুফ জানান, মালয়েশিয়ায় রাত ১২টার পর বাংলাদেশ থেকে আসা কর্মীরা নির্বিঘ্নে ইমিগ্রেশন পার হচ্ছেন। মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করেছে। ৩১ মে বাংলাদেশ ত্যাগ করে যারা মালয়েশিয়ায় আসছেন, ১২টার পরও তারা ইমিগ্রেশন পার হয়েছেন। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মী আছেন। গত বছর সেখানে গেছেন ৩ লাখ ৫১ হাজার ৬৮৩ কর্মী। এ পর্যন্ত ৪ লাখ ৭২ হাজারের বেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় এসেছেন। মালয়েশিয়ার গত মার্চের ঘোষণা অনুযায়ী, ৩১ মে অর্থাৎ শুক্রবারের পর আর কোনো নতুন বিদেশি শ্রমিক দেশটিতে ঢুকতে পারবেন না। সময়সীমার কারণে হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এয়ারলাইনস সংস্থাগুলো আসনসক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি শুক্রবার পর্যন্ত বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করে। কিন্তু ভিসা পাওয়ার পরও ফ্লাইট জটিলতায় বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩১ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি।

সর্বশেষ খবর