শিরোনাম
রবিবার, ২ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

বেনজীরের পার্টনারদের চলছে খোঁজ

সহযোগীদের বাদ দিয়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে না, অভিমত ড. ইফতেখারুজ্জামানের

বিশেষ প্রতিনিধি

বেনজীরের পার্টনারদের চলছে খোঁজ

বেনজীর আহমেদ

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) বেনজীর আহমেদের পার্টনারদের খোঁজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দেশে-বিদেশে বেনজীর আহমেদের সঙ্গে যারা বিভিন্নভাবে অংশীদার এবং ব্যবসায়িক পার্টনার রয়েছেন-তাদের তদন্তের আওতায় আনা হবে। দুদকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, ধাপে ধাপে সবকিছু তদন্ত করা হবে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু নাম পাওয়া গেছে। তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সময় হলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেনজীরের অগাধ সম্পদের তদন্ত করতে গিয়ে তার অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের হদিস মিলেছে। দুবাইকেন্দ্রিক ব্যবসার অনুসন্ধান করতে গিয়ে তার কয়েকজন পার্টনারের সন্ধান পান কর্মকর্তারা। লন্ডনেও তার দু-একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী রয়েছেন। চাকরিতে থাকা অবস্থায় তিনি একাধিকবার সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। সেসব দেশে তার ব্যবসার খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। দুবাইয়ে তার হোটেল ব্যবসার বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। সেখানেও রয়েছে ব্যবসায়িক অংশীদার। বন বিভাগের জমি দখল করে গড়ে তোলা গাজীপুরে ভাওয়াল রিসোর্টের পার্টনারের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। গুলশানসহ বিভিন্ন স্থানে তার ল্যান্ড ব্যবসার সঙ্গে একাধিক পার্টনারের সন্ধান মিলেছে। মিডিয়া এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত তার পার্টনারদের তদন্তের আওতায় নেওয়া হচ্ছে। সূত্র জানায়, কক্সবাজার, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, টুঙ্গিপাড়া, কোটালীপাড়া ছাড়াও সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ে তার জমির সন্ধান পাওয়া গেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাবেক আইজিপির দুর্নীতির সহযোগীদেরও অবশ্যই তদন্তের আওতায় আনতে হবে। তিনি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে যে সম্পদের বিকাশ ঘটিয়েছেন এটি একা করেননি। যোগসাজশে করেছেন। তিনি যে সম্পদ এবং অর্থ উপার্জন করেছেন, সেটি ক্ষমতার অপব্যবহারেই করেছেন তা পরিষ্কার। এক্ষেত্রে তিনি তার প্রাতিষ্ঠানিক এবং পেশার অবস্থানকে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তিনি এটা এককভাবে করেননি। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতায় করেছেন সেটি নয়, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়ও করেছেন। তার সঙ্গে অনেক যোগসাজশকারী ছিল, সহকারী ছিল এবং অংশীজন ছিল। অনেক ক্ষেত্রে সুরক্ষাকারী ছিল। যারা সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিল এমন ব্যক্তিবর্গও ছিল। সত্যিকার অর্থে যদি তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে তার সহযোগীদেরও এর মধ্যে আনতে হবে। অবশ্যই তাদের দায়ী করতে হবে। কিন্তু তার সহযোগীদের বাদ দিয়ে সত্যিকার জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে না এবং ন্যায়বিচার হবে না। এরই মধ্যে তিনি সপরিবারে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে তথ্য জানা যাচ্ছে। স্মার্টলি তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই তিনি পালালেন, এটা নজরদারি সংস্থা বা দুর্নীতি দমন কমিশনের দক্ষতার ঘাটতি কি না তা প্রশ্ন থেকে যায়। নাকি বোঝাপড়ার ঘাটতির কারণে তিনি দেশ থেকে পালালেন তার প্রশ্ন থেকে যাওয়াই স্বাভাবিক।  দুদক সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে বিদেশেও তার সম্পদ অনুসন্ধানে কাজ শুরু করেছে দুদক। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি  দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ অনুসন্ধানের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। অনুসন্ধানে এসব দেশে সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেলে শুরু হবে পরবর্তী কার্যক্রম। এক্ষেত্রে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্টের (এমএলএআর) আওতায় তথ্য চেয়ে চিঠি দেবে সরকার। তার ভিত্তিতে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনাসহ বাকি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।  উল্লেখ্য, দুর্নীতি দমন কমিশন আগামী ৬ ও ৯ জুন বেনজীর আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে তলব করেছে। কিন্তু এই দুই দিন বেনজীরের পরিবারের সদস্যরা দুর্নীতি দমন কমিশনে আসবে কি না তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। একাধিক সূত্রের খবর, পরিবারসহ বেনজীর আহমেদ এখন দেশে নেই। তিনি দেশত্যাগ করেছেন বলে বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে।  দুর্নীতি দমন কমিশন মনে করছে, তিনি দেশে থাকুন আর বিদেশে থাকুন তাকে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। শুধু বেনজীর আহমেদ নয়, বেনজীর আহমেদের সঙ্গে যারা বিভিন্নভাবে অংশীদার এবং ব্যবসায়িক পার্টনার তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হবে।  সূত্রমতে, বেশকিছু কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন বেনজীরের সহযোগীদের তদন্তের আওতায় নেবে। প্রথমত, তার যে ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে, তাতে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, তিনি তার টাকাগুলো উত্তোলন করেছেন। কয়েক শ কোটি টাকার মতো বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। আর এ টাকাগুলো কোথায় গেল, তার উৎস সন্ধান করার কাজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। ব্যাংকে টাকা উত্তোলনের লেজার এবং অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করে দুর্নীতি দমন কমিশন খোঁজার চেষ্টা করছে- কোথায় কোথায় তিনি এই টাকা সরিয়েছেন। অন্য কোনো ব্যবসায়িক পার্টনারের কাছে তিনি টাকা রেখেছেন কি না সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।  সূত্র বলছে, অবসরের পর বেনজীর বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার পার্টনারশিপ তৈরি হয়েছিল বলেও প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। এ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে সাবেক পুলিশপ্রধানের কোনো বিনিয়োগ আছে কি না সেটিও তদন্তে আসছে। এ ছাড়া অন্যান্য কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও বেনজীর আহমেদের ঘনিষ্ঠতার খবর সংগ্রহ করছে দুদক। সূত্র জানায়, আইজিপি থাকাকালে বেনজীর আহমেদ পুলিশের কেনা কাটায় সুনির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতেন। সে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। বেনজীর আহমেদ বিভিন্ন জায়গায় বেনামে বিনিয়োগ করেছেন সেটিরও উৎস খুঁজে বের করা হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন বলছে, তদন্ত চলছে। তদন্তের প্রয়োজনে যখন যাকে দরকার তাকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি অনুসন্ধানে গত ২২ এপ্রিল তিন সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে দুদক। কমিটির সদস্যরা হলেন- কমিশনের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক জয়নাল আবেদীন ও নিয়ামুল হাসান গাজী। ২৩ এপ্রিল হাই কোর্টের এক আদেশে দুই মাসের মধ্যে অনুসন্ধানের অগ্রগতি প্রতিবেদন হলফনামা আকারে জমা দিতে বলা হয়। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ গত ২৩ মে ও ২৬ মে দুই দফায় বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা বিপুল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ দেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে আদালতের আদেশের কপির সঙ্গে চিঠিও পাঠানো হয়। চিঠিতে ওই আদেশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। এর মধ্যে ২৩ মে বেনজীর পরিবারের নামে ৩৪৫ বিঘা জমি, বিভিন্ন ব্যাংকের ৩৩টি হিসাব জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়। আর গত ২৬ মে আদালত বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামের ১১৯টি জমির দলিল, ২৩টি কোম্পানির শেয়ার ও গুলশানের চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন। তবে ব্যাংকের হিসাব জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ বাস্তবায়নের আগেই বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে বিপুল অর্থ সরিয়ে নেন বেনজীর আহমেদ। দুদকের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলেছে, এ টাকার পরিমাণ কয়েক শ কোটি হতে পারে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেনজীর আহমেদ চাকরিকালীন কক্সবাজার, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, টুঙ্গিপাড়া, কোটালীপাড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্ত্রী-সন্তানদের নামে ৬২১ বিঘা জমি কেনেন, যার দলিল মূল্য ও বাস্তব মূল্যে অনেক পার্থক্য পেয়েছে দুদক। এ ছাড়া তালিকভুক্ত ১৯টি কোম্পানি, তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড ও সঞ্চয়পত্রে বিপুল বিনিয়োগের সন্ধান পেয়েছে দুদক।

সর্বশেষ খবর