সোমবার, ৩ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

দ্বারে দ্বারে ঘুরছে ওরা

মালয়েশিয়া যেতে পারেনি ১৬,৯৭০ কর্মী, তদন্ত কমিটি, মামলা করলে ব্যবস্থা নেবে সিআইডি, লাশ উদ্ধার সেই যুবকের

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি

ভিসা ও ছাড়পত্র পেয়েও মালয়েশিয়া যেতে পারেনি ১৬ হাজার ৯৭০ জন বাংলাদেশি কর্মী। এ কর্মীদের বেশির ভাগই কয়েক লাখ টাকা দিয়েছে দালাল ও বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে। এ টাকা ফেরত পেতে গতকাল দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে তারা। এত বিপুলসংখ্যক কর্মীর যেতে না পারার কারণ খুঁজতে তদন্ত কমিটি করেছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কমিটির কাছে অভিযোগ করে টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ থাকবে যেতে না পারাদের। মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা সংক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি মামলা করলে ব্যবস্থা নেবে সিআইডি। প্রতিমন্ত্রী আশা করছেন, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে আলোচনায় শিগগির আবার খুলবে শ্রমবাজার। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সংকট নিয়ে গতকাল বিকালে মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, ৩১ মে পর্যন্ত ৫ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৬ জনকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। বিএমইটির ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ জনকে। ৩১ মে পর্যন্ত যেতে পেরেছেন ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ জন। সেই হিসাবে ১৬ হাজার ৯৭০ জন যেতে পারেননি। সংখ্যাটা কিছুটা কমবেশি হতে পারে। কেন তারা যেতে পারেননি এ ব্যাপারে আমরা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। কমিটিতে ছয়জন সদস্য আছেন। অতিরিক্ত সচিব (মন্ত্রণালয়ের) নূর মোহাম্মদ মাহবুবকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটি তাদের সুপারিশ দেবে। যারা এটার জন্য দায়ী হবেন তাদের বিরুদ্ধে আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেব। যে বা যারা এ তদন্তের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত হবেন তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা কর্মীরা তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ করতে পারবেন এবং প্রয়োজন হলে কর্মীদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করা হবে। শেষ সময়ে কর্মীদের ছাড়পত্র দেওয়ার বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ছাড়পত্র তারা যখন চেয়েছে, রিক্রুটিং এজেন্সি যখন চেয়েছে আমরা প্রয়োজনীয়তা দেখে দ্রুত তা দিয়েছি। না হলে সবাই বলবে মন্ত্রণালয় দেয়নি। সে কারণে যে সময় যেটার প্রয়োজন হয় সেটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কর্মীদের না যেতে পারার পেছনে মন্ত্রণালয়ের কোনো গাফিলতি ছিল না দাবি করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, মন্ত্রণালয়ে গাফিলতি হয়নি। এখনো আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা এক সপ্তাহ আগে চিঠি দিয়েছিলাম মালয়েশিয়া সরকারকে আরও এক সপ্তাহ বাড়ানোর জন্য। মালয়েশিয়ার হাইকমিশনারের সঙ্গে আলাপ করেছি। তিনি ৫ তারিখে মন্ত্রণালয়ে আসবেন। তখন তার সঙ্গে আবারও এ বিষয়ে কথা হবে। বন্ধ হয়ে যাওয়া মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, শ্রমবাজার খুলবে। আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সরকার মালয়েশিয়ার সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। শ্রমবাজার ফের খুলবে। মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. রুহুল আমিন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মালয়েশিয়া যেসব কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে, তাদের নামে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি। ছাড়পত্র পেয়েও যাঁরা যেতে পারেননি, তাঁদের টাকা রিক্রুটিং এজেন্সি ফেরত দেবে। বায়রা এটার দায়িত্ব নিয়েছে। আর যদি কর্মীদের টাকা ফেরত দেওয়া না হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মালয়েশিয়ায় গিয়ে কাজ না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সচিব বলেন, কর্মীদের নিতে দেশটির বিমানবন্দরে আসেন নিয়োগকর্তা। গত কয়েক মাসে কোনো কর্মীকে নিতে না আসার ঘটনা ঘটেনি। আগে যে ৫ হাজার কর্মী কাজ পাননি, তাঁদের কাজের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

সংক্ষুব্ধ কেউ মামলা করলে ব্যবস্থা নেবে সিআইডি : সম্প্রতি শ্রমিক হিসেবে মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা সংক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি মামলা করলে সিআইডি ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া। গতকাল রাজধানীর মালিবাগ সিআইডি সদর দফতরে আয়োজিত ‘অবৈধ অর্থ স্থানান্তর এবং অনলাইন জুয়া নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ’ সম্পর্কিত গবেষণা ফলাফলের প্রচার ও দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। সিআইডি প্রধান বলেন, শুধু মানব পাচার আইনে মামলা নয়, বিদেশ পাঠানোর নামে যারা অবৈধভাবে টাকা আয় করে বিভিন্ন জায়গায় হস্তান্তর করেছে তাদের আমরা মানি লন্ডারিংয়ের আওতায়ও আনব। অবৈধভাবে যারা মানব পাচার করে ভুয়া টিকিট বা ভুয়া ভিসা ইত্যাদি দিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে, অর্থ নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা মানব পাচারের মানি লন্ডারিং মামলা এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি। সিআইডির একটি মানব পাচার সেল আছে। এ সেলটি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে এবং আমাদের একটি ব্রাঞ্চ আছে এয়ারপোর্টে। যারা রিফ্রেক্টেড হয়, বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হয়ে বিদেশ থেকে রিফ্রেক্টেড হয়, আমাদের রিপোর্ট করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাদের সব ডাটা সংগ্রহ করি। মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কিন্তু আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করি ও আসামি গ্রেফতার করি। মানিলন্ডারিং রোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য সিআইডি, এমএফএস, বিটিআরসি এবং বিএফআইইউসহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে নিয়মিত কর্মশালার আয়োজন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা মাদক নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছি। ইতিপূর্বে মাদকের ব্যবহারকারী এবং খুচরা বিক্রেতাদের আমরা আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। আমরা স্পেশাল ডাইমেনশন আকারে গডফাদারদের এবং তাদের যত অবৈধ প্রোপার্টি আছে সেগুলোকে আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। কোনোটা ফ্রিজ করেছি আবার কোনোটা সিজ করেছি।

মালয়েশিয়া যেতে না পারা সেই তানভীরের লাশ উদ্ধার : সাড়ে ৬ লাখ টাকা চুক্তিতে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা ছিল তানভীরের। কিন্তু টিকিট না পেয়ে ৩১ মে উপকূল এক্সপ্রেসে বাড়ি ফিরছিলেন স্বজনদের সঙ্গে। ট্রেনটি ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন পার হওয়ার পর সিট থেকে উঠে দরজার সামনে যান তানভীর। মুহূর্তেই পড়ে যান নিচে। ট্রেন থেকে পড়ে মেঘনা নদীতে নিখোঁজ সেই তানভীরের লাশ উদ্ধার হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় তার লাশ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এর আগে দুপুরে ঘটনাস্থল থেকে সাত কিলোমিটার দূরে নরসিংদী জেলার রায়পুরা ও কুমিল্লা জেলার গৌরিপুর এলাকার মাঝামাঝি স্থান থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌর এলাকার দেবগ্রামের তরুণ  সোহেল মোল্লা তানভীরের লাশ আসার পর বাড়িতে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তানভীরের বয়স বাস্তবে ১৭ বছর। তবে বিদেশ যাওয়ার স্বার্থে পাসপোর্ট করতে গিয়ে কাগজে কলমে বয়স কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সাড়ে ৬ লাখ টাকা চুক্তিতে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা ছিল তানভীরের। ৩১ মে সকালে ঢাকায় যাওয়ার পর জানতে পারেন তানভীরের জন্য বিমানের টিকিট ম্যানেজ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট ট্র্রাভেল এজেন্সি। তাদের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, পাঁচ সাত দিনের মধ্যে টিকিট ম্যানেজ করে তানভীরকে পাঠানো হবে। এ অবস্থায় তানভীর ও তার স্বজনরা উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। ট্রেনটি ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন পার হওয়ার পর সিট থেকে উঠে দরজার সামনে আসেন তানভীর। মুহূর্তেই সে মেঘনা সেতুতে পড়ে যায়। তার বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। সেখানে উপস্থিত লোকজনের কাছ থেকে বিষয়টি শুনে সঙ্গে থাকা স্বজনরা বুঝতে পারেন তানভীরই পড়ে গেছেন। এরপর থেকে তার লাশ খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। এক জেলে নদীতে লাশ ভাসতে দেখে পুলিশে খবর দেন। পরিবারের লোকজন গিয়ে তানভীরকে শনাক্ত করে। কিশোরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ‘গত তিন দিন নৌপুলিশসহ আমরা লাশ উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করি। গতকাল দুপুরে রায়পুরা এলাকায় এক জেলে পানিতে লাশ ভাসতে দেখে সেখানকার পুলিশে খবর দেয়। পুলিশের সহযোগিতায় লাশ উদ্ধার করে স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর