ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলায় গ্রেফতার তানভীর ভুঁইয়া দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। খুনের সময় সরাসরি ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকলেও অনেক কিছু আগে থেকেই জানতেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে ৬ মে ভারতে যান তানভীর। বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে দেশে ফেরেন ১৬ মে। গতকাল ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
অন্যদিকে এ মামলার অন্যতম সন্দেহভাজান আসামি নেপালে আটক সিয়ামকে দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে জটিলতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
৩১ মে তানভীর ভুঁইয়া ওরফে ফয়সাল আলী সাজি, শিলাস্তি রহমান ও শিমুল ভুঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ-এ তিন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দ্বিতীয় দফায় পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। সেই রিমান্ড চলাকালে গতকাল তানভীরকে আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় তিনি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হওয়ায় তার জবানবন্দি রেকর্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সিনিয়র সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। এর আগে ২৪ মে তিন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন অন্য একটি আদালত। সবশেষ সোমবার একই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন শিলাস্তি রহমান। আদালতসূত্রে জানা গেছে, তানভীর ও অন্য আসামিরা পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ভিকটিম আনোয়ারুল আজিম আনারকে প্রলুব্ধ করে কলকাতায় নিয়ে যান। তিনি আনার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহিনের পরিকল্পনার প্রধান সমন্বয়ক আমানুল্যা সাঈদ ওরফে শিমুল ভুঁইয়ার ভাতিজা। তিনি তার চাচা আমানুল্যার পরিকল্পনা অনুযায়ী ৬ মে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতের কলকাতায় যান এবং সেখানে সল্টলেক আর নিউটাউনের মাঝামাঝি ত্রিশিব নামক হোটেলে ওঠেন। সেখান থেকে বিভিন্ন সময় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসামি আমানুল্যা সাঈদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেন। এরপর পরিকল্পনা মোতাবেক ভিকটিম আনারকে প্রলুব্ধ করে কলকাতায় নিয়ে যান তিনি। এদিকে গতকাল বিকালে নেপাল থেকে ফিরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন বলেছেন, এ ঘটনার মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহিনকেও ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হবে। হত্যাকান্ডের পর তাৎক্ষণিকভাবে এনসিবির মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে চিঠি দিয়েছি। শাহিন যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক তাই আমরা ইন্টারপোলকেও অবহিত করেছি। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দিবিনিময় চুক্তি রয়েছে। ভারতও শাহিনকে ফেরাতে ভূমিকা রাখবে। কারণ ভারতের কাছে শাহিন একজন মোস্ট ওয়ান্টেড আসামি। শাহিনকে ফেরাতে বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং করব। তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করব।সিয়ামকে ফেরত আনার বিষয়ে কোনো জটিলতা আছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালের বন্দিবিনিময় চুক্তি নেই। তবে এ বিষয়েও আমরা কাঠমান্ডু পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। সিয়াম ভারতের পুলিশের কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড। ভারতের সঙ্গে নেপালের বন্দিবিনিময় চুক্তি রয়েছে। নেপাল যদি ভারত কিংবা বাংলাদেশের কাছে সিয়ামকে হস্তান্তর করে তবে তদন্তে কোনো সমস্যা হবে না। সিয়াম কাঠমান্ডুতে অবস্থান করছেন এমন খবর পেয়ে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের এনসিবি শাখা থেকে নেপালের এনসিবিতে একটি চিঠি পাঠানো হয়। আমাদের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সিয়ামকে কাঠমান্ডু পুলিশ গ্রেফতার করে। আমি মনে করি, নেপাল ও বাংলাদেশ পুলিশের আন্তরিকতা আরও বাড়বে। নেপালের কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশি অপরাধীরা গিয়ে সেইফ হোম বানাবে, এটি আর হবে না; এ বার্তা কাঠমান্ডু পুলিশ পেয়েছে। তিনি বলেন, যদি একই অপরাধের ক্ষেত্রে দুটি দেশ দাবি করে তবে হোস্ট কান্ট্রি হিসেবে নেপাল বিবেচনায় আনবে অপরাধের ধরনটা কী। হত্যা কোথায় সংঘটিত হয়েছে। নেপাল বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করার পর সিদ্ধান্ত নেবে সিয়ামকে তারা কোন দেশে হস্তান্তর করবে। হারুন অর রশীদ আরও বলনে, ভারত যেহেতু আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। আমাদের ও ভারতের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। বিভিন্ন তথ্য আদানপ্রদান করছি ভারতের সঙ্গে। দুই দেশের তদন্ত কর্মকর্তারা কাজ করছেন এমপি আনার হত্যাকান্ড নিয়ে। সিয়ামকে ভারতের পুলিশের কাছে দিলে আমাদের তদন্তে কোনো সমস্যা হবে না। লাশের খন্ডাংশ উদ্ধারের বিষয়ে তিনি বলেন, এমপি আনারের পরিবার যাবে কলকাতায়। ডিএনএ স্যাম্পল টেস্ট করার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। ঝিনাইদহে আলোচনায় শাহিনের দুই সহযোগী : এমপি আনার নিখোঁজকান্ডে শাহিনের দুই সহযোগী তাজ মোহাম্মদ খান ওরফে হাজি ও মো. জামাল হোসেনের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাজ মোহাম্মদ খান কোটচাঁদপুর বাজারপাড়া এলাকার মৃত লাল মোহাম্মদের ছেলে ও মো. জামাল হোসেন পোস্টঅফিস পাড়া এলাকার আলতাফ হোসেনের ছেলে। স্থানীয়রা জানান, তাজ মোহাম্মদ ও জামাল হোসেন দুজনই আক্তারুজ্জামান শাহিনের ব্যবসাবাণিজ্য দেখভাল করতেন। শাহিন দেশের বাইরে থাকলে তখন তার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন তাজ হাজি। এমপি আনার হত্যাকান্ডের সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকেই এলাকায় তাদের দেখা যায়নি। তাজ হাজি হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি।