শুক্রবার, ৭ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা
বিশ্লেষণ

অতিসতর্ক বিনিয়োগবিমুখ বাজেট

সংকটের স্বীকৃতি আছে মোকাবিলার কৌশল নেই ♦ মূল্যস্ফীতিতে গুরুত্ব প্রবৃদ্ধি অবহেলিত

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তাতে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের স্বীকৃতি থাকলেও মোকাবিলার কৌশল চোখে পড়েনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘোষিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিতে গিয়ে প্রবৃদ্ধিকে অবহেলা করা হয়েছে। ফলে উৎপাদন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং মানবসম্পদ খাতে যতটা গুরুত্ব পাওয়া উচিত ছিল ততটা পায়নি। বরং প্রচলিত বিনিয়োগ সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে বেসরকারি খাতের যে কর অব্যাহতি ছিল, তা প্রত্যাহার করে শুধু সরকারি হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে সুবিধা বহাল রাখা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে ঘোষিত বাজেটটিকে সংকট মোকাবিলায় অতিসতর্ক, বিনিয়োগ বিমুখ বাজেট হিসেবে অভিহিত করা যায়, যেখানে সাহসী পদক্ষেপের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।

সাবেক অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ, তা কোনোভাবেই নামিয়ে আনা সম্ভব হবে না। বরং যেটা উচিত ছিল, এই মূল্যস্ফীতিকে ভিত্তি ধরে প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ বাড়লে মানুষের আয় বাড়ত। তখন মূল্যস্ফীতির চাপও কমে যেত। আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত নির্বাচনি ইশতেহারে ১১ অগ্রাধিকার ছিল, যার প্রথমেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। এরপরই ছিল কর্মসংস্থান ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা, বিনিয়োগ বাড়ানো এবং ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে সক্ষমতা বৃদ্ধি, নিম্নআয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলো। প্রস্তাবিত বাজেটে নির্বাচনি ইশতেহারের ১১ অগ্রাধিকারের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও নির্বাচিত সরকারের প্রথম বাজেটে এ অগ্রাধিকার বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে; নীতিনির্ধারণী সুদের হার বাড়িয়ে সাড়ে ৮ শতাংশ করার উল্লেখ রয়েছে; ব্যাাংক ঋণের সুদের হার ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ওপর ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে; সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্ব নীতির সমন্বয় কৌশল গ্রহণের উল্লেখ রয়েছে; এমনকি সরকারের ব্যয় সংকোচন করতে ঘোষিত বাজেটের আকার খুব একটা যে বাড়েনি- সে কথাও উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে এর বিপরীতে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সুনির্দিষ্ট কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে- তার উল্লেখ নেই ঘোষিত বাজেটে। বিষয়গুলোকে আগামী দিনের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।  

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আগামী অর্থবছরের বাজেটে আমরা ফিসক্যাল কনসোলিডেশন তথা বাজেট ঘাটতি হ্রাস এবং সীমিত কলেবরে হলেও কৃচ্ছ্রসাধন অব্যাহত রাখব। তবে দীর্ঘমেয়াদে এ পন্থা অবলম্বন করা হলে প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে যেতে পারে; সে কারণে লক্ষ্য থাকবে আগামী অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে সরকারি ব্যয় ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করা। এটি সম্ভবপর হবে যদি রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়ানো যায়।’ সুতরাং বলাই যায়, এ বাজেটে প্রবৃদ্ধি হবে না, আগামীর জন্য অপেক্ষা করুন। এ বাজেটে কর্মসংস্থান হবে না, আগামীর জন্য অপেক্ষা করুন। এ বাজেটে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার থাকবে না-আগামীর জন্য অপেক্ষা করুন।

সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির প্রভাব : বাজেটে সংকোচনমূলক রাজস্ব নীতি গ্রহণের ফলে যা ঘটবে : (১) বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের আমানতের নিরাপত্তা রক্ষায় সরকারের ট্রেজারি বিলে বেশি বিনিয়োগ করবে; (২) বেসরকারি খাতে ঋণের সুদহার আরও বাড়বে; (৩) বাজেটের ঘাটতি মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ ঋণের টার্গেট বাড়ায় বেসরকারি খাত কম ঋণ পাবে। এর ফলে যা হবে : (১) সরকারি ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ করায়  বেসরকারি খাতের জন্য বিনিয়োগযোগ্য মূলধনের স্বল্পতা দেখা দেবে; (২) ঋণের সুদ বাড়ায় বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবেন; এবং (৩) সরকারের ঋণ বাড়ায় বেসরকারি খাত পর্যাপ্ত ঋণ পাবে না। ফলাফল : বিনিয়োগ কমে গেলে, উৎপাদন কমে যাবে। কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বিনিয়োগ বিমুখ বাজেট : প্রস্তাবিত বাজেটে ঘোষিত করকাঠামোও বিনিয়োগ বান্ধব নয়। বিভিন্ন খাতে ‘কর অব্যাহত’ সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। উপরন্তু কর অব্যাহতি সুবিধা ভোগ করার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার পরামর্শ রয়েছে বাজেটে। তবে পণ্য খালাসে জটিলতা নিরসন ও প্রক্রিয়া সহজীকরণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানিমুখী শিল্পকে সহায়তা দেওয়ার উল্লেখ রয়েছে। এসবই প্রতিশ্রুতি। বাজেট বক্তৃতায় বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ উন্নয়নে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর ওয়ান স্টপ সার্ভিসের কথা বলা হলেও বাস্তবে এ সুবিধা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে, যা নতুন কিছু নয়।

বাজেটে যেসব সংকট তুলে ধরা হয়েছে : উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ স্বল্পতা, ডলারের বিপরীতে টাকার অবচয়ের বিষয়গুলো বাজেট বক্তৃতায় উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত টাকার মান হারিয়েছে ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ। যে কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। গত মে মাসে রিজার্ভ কমে ২৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।  টাকার মান ধরে রাখতে আলোচ্য সময়ে রিজার্ভ থেকে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছাড়তে হয়েছে। তবুও টাকার অবচয় হ্রাস করা যায়নি।

রিজার্ভ সংকটের কারণ হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধকে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, যুদ্ধের কারণে ইউরোপ-আমেরিকাতেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। নিয়ন্ত্রণে সেখানকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতিনির্ধারণী সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। এতে সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হয়। উন্নত বিশ্বে সুদের হার বাড়ায় দেশ থেকে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী তাদের মূলধন প্রত্যাহার করে নিয়ে গেছেন। অন্যদিকে নতুন বিনিয়োগও আসেনি। এর ফলে সরকারের ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি বেড়েছে। এর ওপর বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ বার্ষিক ব্যয় ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আরও বলা হয়েছে, উন্নত বিশ্বে সুদের হার না কমালে এ ধারা অব্যাহত থাকবে। এর অর্থ হচ্ছে, রিজার্ভ সংকট কাটানোর আশু সমাধান নেই।

বাজেটের ভালো দিক : এত কিছু না থাকার মাঝেও বাজেটের কিছু ভালো দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে, মাটির নিচের সম্পদ উত্তোলনে বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ খাতে গবেষণা উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সমুদ্র তলদেশের খনিজ সম্পদ আহরণে বাজেটে বরাদ্দও রাখা হয়েছে। এটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে সহায়তা করবে। ফলে গ্যাসের সংকট কমানোর উদ্যোগ রয়েছে ঘোষিত বাজেটে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে দেশি ও প্রবাসীদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই বেজড সলিউশন ডেভেলপমেন্ট, রোবটিং সফটওয়্যার, ডিজিটাল ডাটা, মোবাইল অ্যাপ, ই লার্নিং, অ্যানিমেশন, আইটি ফ্রিল্যান্সিংসহ বিভিন্ন খাতে তিন বছরের করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করতে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়ানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হাত থেকে মধ্যবিত্তকে সুরক্ষা দিতে নিত্যপণ্যে শুল্ককর কমানো হয়েছে। দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সেবা খাতের নীতিসহায়তা দিতে জাতীয় লজিস্টিক নীতি প্রণয়নের বিষয়টি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়তা করবে।

সর্বশেষ খবর