শিরোনাম
শনিবার, ৮ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

কঠিন সময়ে দুর্বল বাজেট

নিজস্ব প্রতিবেদক

কঠিন সময়ে দুর্বল বাজেট

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটকে এক্সট্রা অর্ডিনারি সময়ে অর্ডিনারি বাজেট বলে অভিহিত করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি মনে করে, মূল্যস্ফীতি প্রবৃদ্ধি বিনিয়োগের প্রাক্কলন অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী এবং বাস্তবতাবিবর্জিত। এ কারণে এ বাজেটের অনেক কিছুই অর্জিত হবে না। এটি কঠিন সময়ে দুর্বল বাজেট। গতকাল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের  প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলা হয়। বাজেটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘চলমান অর্থনৈতিক উদ্বেগ মোকাবিলায় যে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে নেওয়া হয়নি। মূল্যস্ফীতি রোধ ও নিম্ন আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে বাজেটে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা যথেষ্ট নয়। কারণ মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশ নামিয়ে আনার লক্ষ্য উচ্চাকাক্সক্ষা ছাড়া কিছু নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি, জিডিপি গ্রোথ, বিনিয়োগের যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা অতিউচ্চাভিলাষী ও বাস্তবসম্মত নয়। বাজেটে অর্থনৈতিক সূচকের অনেক লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ অনুধাবন করতে না পারায়, বাজেটে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা দুর্বল ও অপর্যাপ্ত। সব মিলিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটটি অসাধারণ সময়ে একটি সাধারণ বাজেট।’ এ সময় আরও বক্তব্য দেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

ড. ফাহমিদা বলেন, রাজস্ব আহরণ থেকে শুরু করে ব্যাংক খাত সব ক্ষেত্রেই দুরবস্থা চলছে। এর পেছনে রয়েছে তারল্য সংকট, রপ্তানির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ না বাড়া, আমদানি কমিয়ে দেওয়াসহ অনেক কারণ। প্রবৃদ্ধি নিয়ে একসময় গর্ব করা হলেও এখন তলানিতে ঠেকেছে। কিন্তু এসব সংকট মোকাবিলা করার জন্য এ বাজেট যথেষ্ট সাহসী, সৃজনশীল এবং গঠনমূলক হয়নি। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, আগামী বাজেটের প্রধান পদক্ষেপ হওয়া উচিত ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা, প্রবৃদ্ধি নয়। কিন্তু গত দুই বছর ধরে চলমান ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি আগামী অর্থবছরে সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে নিয়ে আসার উচ্চাকাক্সক্ষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু কীভাবে এই লক্ষ্য অর্জন করবে তা একটি বড় প্রশ্ন হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি থেকে নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে যাচ্ছে সরকার, যা মোট বাজেটের ১৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, গতবার বাজেটে ১৭ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক ৪ শতাংশ ছিল সামাজিক সুরক্ষা খাতে। এবার তা হয়েছে বাজেটের ১৭ দশমিক ১ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। কিন্তু সামাজিক সুরক্ষা খাতের ভিতর পেনশনের টাকা, সঞ্চয়পত্রের সুদ, কৃষিতে ভর্তুকি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা রাখা হয়েছে। এসব বাদ দিলে সামাজিক সুরক্ষায় দেওয়া হয়েছে জাতীয় বাজেটের ৯ শতাংশ এবং জিডিপির ১ শতাংশ, যা কোনোভাবেই যথেষ্ট নয় বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায়। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি করতে আরেকটি প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সরকার আগামী অর্থবছরে ‘গ্রস’ রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। চলতি অর্থবছরের জন্য এ লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল ২৯ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। সিপিডি বলছে, চলতি বছরের ৫ জুন পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ‘গ্রস’ রিজার্ভের পরিমাণ ২৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। যেখানে আমরা গত অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারিনি, সেখানে কেন আমাদের এবারের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ধরা হলো। তিনি বলেন, রিজার্ভ বাড়ার একটি বড় জায়গা হলো বিনিয়োগ বাড়ানো। কিন্তু গত দুই বছর ধরে আমাদের বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। এবারও সরকার বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিতে যাচ্ছে। গত বছরেও এমন লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ব্যাংক থেকে যদি সরকার ঋণ নেয় তাহলে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা কোথা থেকে ঋণ নেবে। এভাবে তো বিনিয়োগের পরিবেশ আরও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এবার আয়কর আইনে একটি বিষয় সংযুক্ত করা হচ্ছে যে, অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করলে পরবর্তীতে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না। এর মাধ্যমে সুশাসনকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, কর ফাঁকিতে উৎসাহিত করা হয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা কর দিলেই তা বৈধ হবে, তার ?দুর্নীতি, অনিয়মকে ধরা হবে না, এমন সুযোগ রাখা কতটুকু গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এখানে একটি রাজনৈতিক অর্থনীতি আছে। কালো টাকার মালিকদের মাথায় হাত বুলানো হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে স্পষ্ট বলা হয়েছে- দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে থাকবে সরকার। কিন্তু বাজেটে কর ও ঋণ খেলাপিসহ দুষ্টচক্রকে মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের টাকা অর্থনীতিতে আনার প্রচেষ্টায় করহার কমানো হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, একটি নতুন সরকারের পুরনো বাজেট হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে থাকা মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী বাজেট কৌশলে মুনশিয়ানা দেখাতে পারেননি। এ বাজেট দিয়ে অর্থনীতি মূল ধারায় ফিরে আসবে না।

সর্বশেষ খবর