শনিবার, ৮ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

নেপালে আটক সিয়াম এখন কলকাতা পুলিশের হাতে

ভারতে এমপি আনার খুন রহস্য

প্রতিদিন ডেস্ক

নেপালে আটক সিয়াম এখন কলকাতা পুলিশের হাতে

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার খুনের ঘটনায় নেপাল পুলিশের হাতে আটক সিয়াম এখন কলকাতায় সিআইডির হেফাজতে। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এদিকে চাঞ্চল্যকর এ খুনের ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে ঝিনাইদহ শহরের আদর্শপাড়া থেকে কাজী কামাল আহম্মেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু নামে একজনকে আটক করেছে ঢাকার ডিবি পুলিশ। তিনি এই মামলার অন্যতম আসামি শিমুল ভূঁইয়ার আত্মীয় এবং জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক। এ ছাড়া কলকাতা সিআইডির রিমান্ড শেষে জিহাদ হাওলাদারকে ১৪ দিন জেল হেফাজতে রাখার আদেশ দিয়েছেন ভারতের আদালত।

গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, এমপি আনার হত্যাকান্ডে জড়িত সিয়ামকে ভারতীয় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে নেপাল পুলিশ। কলকাতা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সিয়ামকে হত্যাকান্ডের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। রাজধানীর কোরবানির পশুর হাটে ডিএমপির নেওয়া নিরাপত্তা বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান। ডিএমপি কমিশনার বলেন, যেখানে ঘটনা সংঘটিত হয় সেখানে তদন্ত হয়। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের আইনে আছে, বিদেশে যদি কোনো বাংলাদেশি অপরাধ করে থাকে সেই অপরাধীকে বাংলাদেশে এনেও বিচার করতে পারি। তিনি বলেন, এ ঘটনা ভারতও তদন্ত করছে, বাংলাদেশ পুলিশও তদন্ত করছে। তদন্তের বিষয়ে দুই দেশ এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।

জানা গেছে, ঢাকায় তদন্তসংশ্লিষ্টরা এ পর্যন্ত তদন্তে যেসব তথ্য পেয়েছেন তার সঙ্গে কলকাতা সিআইডি কসাই জিহাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে গুমের বিষয়টি একসূত্রে গাঁথার চেষ্টা করছে। তবে কোনো আলামত না পাওয়ায় আটকে আছে তদন্তের গতি। এর মধ্যে ঢাকার আদালতে তিনজনের দেওয়া স্বীকারোক্তির তথ্যও পেয়েছে কলকাতা সিআইডি। আমাদের ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যা মামলার আসামির কললিস্টে নাম থাকায় সন্দেহভাজন আওয়ামী লীগ নেতা কাজী কামাল আহম্মেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে আটক করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে শহরের স্টেডিয়াম পাড়ার টিটিডিসি সড়কের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। আটক বাবু ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক এবং পৌর এলাকার ভুটিয়ারগাতি গ্রামের রায়হান উদ্দীন বিশ্বাসের ছেলে। স্থানীয়রা জানান, এমপি আনার হত্যার অন্যতম হোতা শিমুল ভূঁইয়ার নিকট আত্মীয় কাজী কামাল আহম্মেদ বাবু। আনার হত্যার ঘটনায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যেতে পারে বলে প্রাথমিক ধারণা করা হচ্ছে।

আটক বাবুর বড় ভাই কাজী গিয়াস আহম্মেদ জানান, আনার হত্যার হোতা শিমুল ভূঁইয়ার মোবাইল ফোনের কললিস্টে নাম থাকায় বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, ‘জনযুদ্ধ (লাল পতাকা) প্রধান কোটচাঁদপুরের বাসিন্দা ডা. মিজানুর রহমান টুটুল আমাদের মামাতো ভাই। শিমুলের বোনকে বিয়ে করেছিলেন ডা. টুটুল।  সেই সূত্র ধরে আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল র্ভূইয়া এবং শাহিন উভয় আমাদের আত্মীয়। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের শুধু কেবল আত্মীয়তার সম্পর্ক, এর বাইরে কিছু নেই। কলকাতা প্রতিনিধি জানান, আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত সন্দেহভাজন ব্যক্তি জিহাদ হাওলাদারকে ১৪ দিনের বিচার বিভাগীয় হেফাজতের (জেল হেফাজত) নির্দেশ দিয়েছেন ভারতের আদালত। দুই দিনের সিআইডি হেফাজত শেষে শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসত জেলা ও দায়রা আদালতে তোলা হয় জিহাদকে। তাকে তোলা হয় আদালতের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শুভঙ্কর বিশ্বাসের এজলাসে। আদালত তাকে ১৪ দিনের বিচার বিভাগীয় হেফাজতের নির্দেশ দেন। সেক্ষেত্রে আগামী ২১ জুন ফের তাকে আদালতে তোলা হবে। আদালতের এ রায়ের পরই তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দমদমের কেন্দ্রীয় কারাগারে। প্রয়োজনে আদালতের অনুমতি নিয়ে সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা কারাগারে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন। গত ২৩ মে জিহাদকে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ থেকে গ্রেফতার করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সিআইডি। ২৪ মে প্রথমবার তাকে বারাসাত আদালতে তোলা হয়। এরপর মোট দুই দফায় ১৪ দিনের সিআইডি হেফাজতের নির্দেশ দেন আদালত। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ভারতীয় দন্ডবিধির ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ), ৩০২ (অপরাধমূলক নরহত্যা), ২০১ (তথ্য-প্রমাণ লোপাট) এবং ১২০বি (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র)- এই চার ধারায় মামলা দেওয়া হয়েছে। নিজেদের হেফাজতে নিয়ে সিআইডি জিহাদের বক্তব্য যাচাই করার পাশাপাশি তাকে সঙ্গে নিয়ে খুন হয়ে যাওয়া সংসদ সদস্যের শরীরের অঙ্গগুলো উদ্ধার করার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনে যায়। এমনকি জিহাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ভাঙড়ের বাঘজোলা খাল, নিউটাউনের হাতিশালা খালেও তল্লাশি অভিযান চালানো হয়। তবু ওই খাল থেকে এমপি আনারের লাশের টুকরোর সন্ধান মেলেনি।

উল্লেখ্য, গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য চুয়াডাঙ্গার দর্শনরি গেদে সীমান্ত হয়ে ভারতে যান এমপি আনার। ১৩ মে সঞ্জীভা গার্ডেনে এমপি আনারকে খুন করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। ওইদিন এমপি ঢোকার আগে থেকে উপস্থিত ছিল অভিযুক্ত জিহাদ। বিকালের দিকে এমপি আবাসনে ঢোকার পর বাইরের ধকল কাটাতে বেসিনে হাত-মুখ ধুচ্ছিলেন। সেই সময়ই  পেছন থেকে ক্লোরোফোম দিয়ে তাকে বেহুঁশ করা হয়। তারপর বালিশচাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। এরপর জিহাদ কসাই ধারালো অস্ত্র দিয়ে এমপির চামড়া থেকে মাংস আলাদা করে সেগুলোকে তিনটি প্লাস্টিকের ডিস্পোজাল ক্যারিব্যাগে ভরে রাখে। পরে সেই লাশের টুকরোগুলোকে ট্রলিব্যাগে ঢোকায় এবং সেগুলোকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলার ভাঙড় কৃষ্ণমাটি এলাকায় আলাদা আলাদা করে ফেলা হয়। জিহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এমনটাই জানতে পেরেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। জঘন্য হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক আক্তারুজ্জামান শাহিনের নির্দেশেই এ হত্যাকান্ড হয়েছে বলেও স্বীকার করেন। মূলত আক্তারুজ্জামানের নির্দেশে জিহাদসহ চারজন ওই এমপিকে তার নিউটাউনের ওই ফ্ল্যাটে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন বলে অভিযোগ। এই খুনের তদন্ত করতে কলকাতা সফর করে ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দাদের একটি প্রতিনিধি দল। এমপি আনারের টুকরো টুকরো লাশের সন্ধানে ভারতীয় নৌবাহিনী ও কলকাতা পুলিশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দলের সহায়তা নিয়ে ভাঙড়ের কৃষ্ণমাটি খাল এলাকায় সিআইডির প্রতিনিধি দল অভিযান চালিয়েছে, তবু সফলতা মেলেনি। তবে খালে এমপি আনারের দেহাবশেষ খুঁজে না পাওয়া গেলেও নিউটাউনের যে সঞ্জীভা গার্ডেনে গত ১৩ মে খুন হয়েছিলেন বলে অভিযোগ, সেই আবাসনের সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয় কিছু অংশ। যদিও সেই মাংস এমপি আনারের কি না তা এখনো নিশ্চিত নয়। উদ্ধারকৃত এই মাংস পরীক্ষার জন্য ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে ‘সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি’ (CFSL) -এ। প্রয়োজনে করা হবে ডিএনএ টেস্ট। আর এই সময়ের মধ্যেই হার ও মাথার খুলি উদ্ধার করা গেলে এ খুনের তদন্ত গতি পাবে বলেও ধারণা তদন্ত কর্মকর্তাদের।

সর্বশেষ খবর