রবিবার, ৯ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা
কী পেলাম এই বাজেটে

ঋণের সুদ পরিশোধই বড় দুশ্চিন্তা

বাড়ছে কিস্তি

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে যে হারে ব্যয় বাড়ছে- তা এখন সরকারের বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তত আরও দুই বছর এই ঋণের চাপ অব্যাহত থাকবে বলে সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। দুটি কারণে বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় বাড়বে বলে নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে। (১), উন্নত দেশগুলোর সুদহার সামনের দিনগুলোতেও বেশি থাকবে; (২), স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের ফলে দাতা সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে আর নমনীয় শর্তে ঋণ দেবে না। অর্থ মন্ত্রণালয় আশঙ্কা করছে, ২০২৬-২৭ অর্থবছরে দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে সরকারের ব্যয় দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের সুদ ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ। ওই সময় সুদ ব্যয় বাজেটের ১৫ দশমিক ৩ শতাংশে উঠে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়েছে নীতি বিবৃতিতে।  চলতি অর্থবছরে সুদ পরিশোধে বাজেটের ১২ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ ছিল। সংশোধিত বাজেটে সেটি বাড়িয়ে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে দেশি-বিদেশি সুদ পরিশোধে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৪ দশমিক ২৪ শতাংশ। নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাড়তে থাকা ঋণের সুদ বাবদ সরকারের ব্যয় আগামী ২০২৬-২৭ অর্থবছরে বেড়ে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় উঠে যেতে পারে। শুধু যে সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়বে তা নয়, সুদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্পে বিপরীতে গৃহীত বিদেশি ঋণের আসল পরিশোধেও চাপ বাড়বে সামনের দিনগুলোতে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের আসল বাবদ ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। চলতি অর্থবছরে যা বেড়ে ২ হাজার ৪৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উঠে গেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২ হাজার ৬২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হবে। ২০২৬-২৭ অর্থবছরে আসলের কিস্তি পরিশোধের দায় ৩ হাজার ১৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বেড়ে যেতে পারে।  সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বিভিন্ন বন্ড বা ট্রেজারি বন্ড ছেড়ে অথবা টাকা ছাপিয়ে সামাল দিতে পারলেও সবচেয়ে বড় সমস্যা তৈরি হবে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ নিয়ে। কারণ সরকারের কাঁধে ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’ হয়ে চেপে বসেছে মেগা প্রকল্পের ঋণ ও সুদ পরিশোধের দায়। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ আরও বাড়বে। ডলারের সরবরাহ আরও কমে যেতে পারে। প্রয়োজনীয় ডলারের অভাব পড়লে তা শুধু বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ বাধাগ্রস্ত করবে তাই নয়, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে সংকট আরও তীব্র হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ীসহ কিছু মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।

আবার পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ কিছু মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। ঋণের শর্ত অনুযায়ী ছাড়ের মেয়াদ (গ্রেস পিরিয়ড) শেষ হওয়ার পর এসব প্রকল্পের সুদ-আসলে কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে এখন। এর ফলে সরকারের বিদেশি ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ‘বাংলাদেশের বৃহৎ ২০টি মেগা প্রকল্প : প্রবণতা ও পরিস্থিতি’ শীর্ষক নাগরিক প্ল্যাটফরমের এক গবেষণায় দেখা গেছে, চলমান ২০ মেগা প্রকল্পের সর্বমোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলার নেওয়া হয়েছে বিদেশি ঋণ হিসেবে। এসব প্রকল্পে ঋণ পরিশোধের সবচেয়ে বড় অংশ ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ দিতে হবে রাশিয়াকে, জাপানকে দিতে হবে ৩৫ শতাংশ এবং চীনকে প্রায় ২১ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক শিক্ষক প্রফেসর মইনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অনেকগুলো খামখেয়ালি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল, যেগুলো সাদা হাতির মতো বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব প্রকল্পের সুদ-আসলে যে অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে, তা শুধু রিজার্ভে চাপ বাড়াচ্ছে তাই নয়, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও নষ্ট করছে। আগামী ২০২৯ সাল পর্যন্ত এ চাপ অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত এ অধ্যাপক।  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আবদুল বায়েস বলেন, বিদেশি ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় বাড়লে তা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়াবে। এজন্য সরকারকে রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় বাড়ানোর পাশাপাশি বৈদেশিক অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করতে হবে।

সর্বশেষ খবর