রবিবার, ৯ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা
কী পেলাম এই বাজেটে

বাধাগ্রস্ত হবে বিনিয়োগ

বাণিজ্য সংগঠন

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাজেটে পোশাক শিল্পের নীতিসহায়তা কমেছে। এ ছাড়া বাজেটে ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক খাত থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে। ব্যাংক সরকারকে বেশি ঋণ দিলে ব্যবসায়ীরা ঋণ পাবে না। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। গতকাল উত্তরায় বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেছেন সংগঠনের নেতারা।

বিজিএমইএ সভাপতি এস এম মান্নান বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলের মূলধনী যন্ত্রাংশ ও নির্মাণসামগ্রীর আমদানি শুল্ক ০ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ নির্ধারণ নতুন বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক বা শিল্পাঞ্চলের বাইরে বিনিয়োগ করার জন্য আরও পাঁচ বছর যেন সময় দেওয়া হয় সেই দাবিও আমরা জানিয়েছি। এই সুযোগ যদি না দেওয়া হয় তাহলে বিনিয়োগে বড় বাধা হবে।

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ব্যাংক যখন সরকারকে ঋণ দেওয়ার সুযোগ পাবে তখন ব্যবসায়ীদের দিতে চাইবে না। এটাই স্বাভাবিক। এতে করে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। বিগত বছরগুলোতে এমনিতেই বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে। বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ১ লাখ ডলার রপ্তানি করলে তারা ৩ হাজার ৮০০ ডলার প্রণোদনা পায়। তাদের যন্ত্রপাতি উৎপাদনসহ সব ধরনের সুবিধা রয়েছে। বিগত কয়েকদিন ধরে অনেক কারখানায় গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জে কারখানাগুলোতে উৎপাদন কমে গেছে। আবার প্রশাসন থেকে সবাইকে ঠিকমতো বেতন-ভাতা দিতে বলা হয়েছে। যদি গাড়িতে তেল না দিয়ে ড্রাইভারকে চাবুক মারেন- গাড়ি চালাও, এটা সম্ভব না। গ্যাস সংকটের কারণে আমাদের অর্ডার প্রত্যাহার হচ্ছে। আমি গ্যাস সংকট সমাধানে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে দ্বিমত পোষণ করেছেন ব্যবসায়ীদের তিন শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ। তারা বলেছেন, এমন কোনো দাবি অর্থমন্ত্রীর কাছে জানানো হয়নি। এর আগে তিন সংগঠনের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান। এতে বলা হয়েছে, তাদের প্রত্যাশা ছিল বাজেটে পোশাকশিল্পের জন্য কিছু নীতিসহায়তা থাকবে। বিশেষ করে তাদের প্রত্যাশা ছিল, উৎসে কর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে এবং এটিকে চূড়ান্ত কর দায় হিসেবে গণ্য করা হবে। সংগঠন তিনটি বলেছেন, এ বিষয়ে তাদের গভীর প্রত্যাশা ছিল; সেই প্রত্যাশা এখনো আছে। তারা জানান, ২০২৯ সাল পর্যন্ত পোশাক খাতের বিদ্যমান প্রণোদনা অব্যাহত রাখা এবং বিকল্প প্রণোদনা চালু না করা পর্যন্ত চলমান প্রণোদনা কাটছাঁট না করা, এক্সিট পলিসি প্রবর্তন, ফুড রেশনিংয়ের জন্য বিশেষ তহবিল বরাদ্দ রাখার জন্য।

পাশাপাশি আরও কিছু প্রত্যাশা ছিল তিনটি সংগঠনের। যেমন- বাজেটে প্রণোদনার ওপর আয়কর অব্যাহতি, শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য ও সেবা ভ্যাটমুক্ত রাখা, এইচএস কোড ও ওজনসংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করা, ইআরকিউয়ের ওপর আয়কর ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা, অগ্নি ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রে আমদানি কর রেয়াত, পোশাকশিল্পের ঝুট থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট এবং রিসাইকেল ফাইবার সরবরাহের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা আসবে। কিন্তু এসব ঘোষণা না আসায় হতাশা প্রকাশ করেছে তিন সংগঠন। তিনটি সংগঠনের দাবি, কাস্টমস আইন ২০২৩-এর ১৭১ ধারায় আমদানি করা পণ্যের এইচএস কোড ভুল হলে যে ২০০ থেকে ৪০০ শতাংশ জরিমানার বিধান করা হয়েছে, সেটা তারা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছে। ভুলের জন্য অতি উচ্চ হারে মাশুল নেওয়া কোনোভাবেই যুক্তিসংগত নয়। পাশাপাশি নতুন কাস্টমস আইন বাস্তবায়নের আগে সব অংশীদারের সঙ্গে আলোচনা করার আহ্বান জানিয়েছে তারা। বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ বলেছে, বাজেটে বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে, যেগুলো বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সহায়ক হবে না বলে মনে করছে তারা। তার মধ্যে হলো- স্টিল বিল্ডিং তৈরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের নির্মাণসামগ্রীর ওপর আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব। অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবস্থিত কারখানার ক্ষেত্রে মূলধনী যন্ত্রাংশ ও নির্মাণসামগ্রীর আমদানি শুল্ক ১ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব। জ্বালানি সাশ্রয়ী বাতির ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব। নতুন বন্ড লাইসেন্স ফি ৫০ হাজার টাকার পরিবর্তে ১ লাখ টাকা এবং লাইসেন্স নবায়ন ফি বার্ষিক ৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব।

লক্ষ্যমাত্রা অর্জন চ্যালেঞ্জ হবে -এফবিসিসিআই :  দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির-এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরের মে মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে এনে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। গতকাল আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই আইকনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এফবিসিসিআই। এ সময় এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি আমিন হেলালী, সহসভাপতি যশোদা জীবন দেবনাথ, ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ, এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি রহমান, বিকেএমইএর নির্বাহী মোহাম্মদ হাতেম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।  মাহবুবুল আলম বলেন, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতেই হবে। তা না হলে সাধারণ মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তি বাড়বে। ভূরাজনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে আমাদের অর্থনীতিতে এমনিতেই বিরূপ প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার উচ্চ বিনিময় হার, ঋণের সুদের হার, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাজেট বাস্তবায়নের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। দেশের জিডিপির আকার এবং অর্থনীতির পরিকাঠামো বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাজেটের আকারও প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বিগত কয়েক বছরে যেখানে প্রায় ১০-১২ শতাংশ হারে বাজেট বৃদ্ধি করা হয়েছে, এবার বাড়ানো হয়েছে ৫ শতাংশেরও কম (৪.৪২)। বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য দরকার সুশাসন ও যথাযথ মনিটরিং। বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং তদারকির মান ক্রমাগতভাবে উন্নয়নের জন্য সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও পরিকল্পনা নিশ্চিত করা জরুরি। এ ছাড়াও বাজেটে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারি এবং বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্ব আরও জোরদার করতে হবে। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৯.৭ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্য ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে আসবে ৬৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এ বিশাল রাজস্ব সংগ্রহ করা হবে সরকারের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এমনিতেই দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকসহ রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়া বিশ্বব্যাপী বিরাজমান কঠিন পরিস্থিতির কারণে চাপের মুখে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ে ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার জরুরি। সেই সঙ্গে কর জিডিপি হার বৃদ্ধির জন্য করের আওতা বাড়ানো এবং উপজেলা পর্যন্ত কর অফিস বিস্তৃত করা প্রয়োজন।  মাহবুবুল আলম বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪.৬ শতাংশ। যদিও চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি রাখা ছিল ৫.২ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে সরকারকে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা নিতে হবে। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিতে হবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সেই সঙ্গে সরকারকে সুদের বোঝা টানতে হচ্ছে। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অধিক মাত্রায় সরকারের ঋণ গ্রহণ বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে স্থানীয় ব্যাংক ব্যবস্থার পরিবর্তে যথাসম্ভব সুলভ সুদে ও সতর্কতার সঙ্গে বৈদেশিক উৎস হতে অর্থায়নের জন্য নজর দেওয়া যেতে পারে।

সর্বশেষ খবর