মঙ্গলবার, ১১ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

অর্থনীতির প্রতিটি খাতই সংকটে

নিজস্ব প্রতিবেদক

অর্থনীতির প্রতিটি খাতই সংকটে

দেশের অর্থনীতির প্রতিটি খাতই এখন সংকটে রয়েছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, সর্বব্যাপী দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই দুর্নীতি হয়, কিন্তু আমাদের দুর্নীতিটা শীর্ষদের চেয়েও শীর্ষে। গতকাল রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াব ও সম্পাদক পরিষদের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘অর্থনীতির চালচিত্র ও প্রস্তাবিত বাজেট ২০২৪-২৫’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য সর্বব্যাপী দুর্নীতিই দায়ী। দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ক্রমাগত ঋণ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমাদের পুঞ্জীভূত ঋণের অর্ধেকই সুদ। ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণহীন ও অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এটা অর্থনীতিতে আস্থার পরিবেশ নষ্ট করেছে। আমরা হয়তো অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হব না। তবে বাজেটটাই ঋণের ফাঁদে পড়তে পারে। দেশ থেকে অবাধে পুঁজি পাচার হয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির জন্য সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সবাই মনে করে, দাম বাড়াতে হবে এবং বাড়াচ্ছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলো কাজে আসছে না। অবশ্য এর জন্য কার্যকর কোনো কৌশলও নেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, রেমিট্যান্স ইতিবাচক ধারায় নেই, রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও আশাব্যঞ্জক নয়। এর আগেও এসব সংকট ছিল, কিন্তু তখন প্রকাশ পায়নি। এখন রিজার্ভ সংকট, সামগ্রিক অর্থনীতিতে মন্দা, তাই এগুলো প্রকাশ পাচ্ছে। আগে নেতিবাচক দিকগুলো সামাল দেওয়া গেলেও এখন সামাল দেওয়া কঠিন। দেশের ব্যাংক খাত প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণকারী ব্যাংক খাতই এখন অরক্ষিত, নিয়ন্ত্রণহীন। এটা বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে। কোটি কোটি টাকা তছরুপ হচ্ছে, আবার টাকা জমাও হয়, রাতারাতি সে টাকাও উধাও হয়ে যায়। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি একটা ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। ভঙ্গুর পরিস্থিতির মধ্যেই জাতীয় বাজেট উত্থাপন হয়েছে সংসদে। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। তারপরও প্রতি বছরই এনবিআরের টার্গেট বাড়ানো হচ্ছে। ব্যাংক খাতের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম আর খেলাপির পাল্লা ভারী হচ্ছে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার আর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। আমাদের বাজেটের অবস্থা দেখলে বোঝা যায়, রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে নিম্নতম হারের দিকে আমরা অবস্থান করছি। এর সঙ্গে রয়েছে আইএমএফের চাপ আর নানা রকম ভর্তুকির বোঝা।

ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, এখন বাজেটে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকের ওপর আরও চাপ বাড়বে। যার নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারে বেসরকারি খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিলে আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হবে। এর মধ্যেই খেলাপি ঋণ বেড়ে রেকর্ড তৈরি হয়েছে। এ খেলাপি ব্যাংক খাতের সংকট আরও ঘনীভূত করছে। এতে ব্যাংকগুলো নতুন করে ঋণ দেওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হবে। ব্যাংক থেকে ছোট উদ্যোক্তারা তো ঋণই পাবে না। পাচ্ছেও না।

তিনি বলেন, একজন ব্যাংকে টাকা রাখলেন আবার রাতারাতি ব্যাংক থেকে সেই টাকা উধাও করে ফেললেন, এটা কীভাবে সম্ভব হয়। স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগের পাশাপাশি বিএফআইইউকে (বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) কাজে লাগাতে হবে। শুনেছি সেটাও নাকি এখন আর স্বাধীনভাবে কাজ করে না। বাজেটে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে ড. ওয়াহিদ উদ্দিন বলেন, আমাদের বিনিয়োগ সেই একটা জায়গাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিনিয়োগের জন্য একটা সুষ্ঠু পরিবেশই আমরা তৈরি করতে পারিনি। অথচ নব্বইয়ের দশকে ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা একই রকম ছিল। তারা এখন অনেক ওপরে চলে গেছে। আমরা পিছিয়ে পড়ছি। একটা কমিউনিস্ট রাষ্ট্র আমেরিকার বিনিয়োগ টানতে পারছে আর আমরা পিছিয়ে পড়ছি।

তিনি বলেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় নতুন করে কোনো মেগা প্রজেক্ট নেওয়া যাবে না। যে প্রকল্প চলছে বা আসছে তার ভবিষ্যৎও দেখতে হবে। এর মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে কী সুফল আসবে তা-ও দেখার বিষয়। তবে কিছু প্রকল্প অনেক কাজের, অবদানও রয়েছে। বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে আমাদের খরচ কমাতে হবে। একই সঙ্গে কালো টাকা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার সুযোগে দেওয়া হয়েছে। অথচ সৎ ব্যবসায়ীরা এখানে ৩০ শতাংশ দিচ্ছেন। আর অসৎরা ১৫ শতাংশ দিয়ে কালো টাকাকে সাদা বানিয়ে ফেলছেন। এটার ফলে ক্রমেই আমরা ‘স্মার্ট নৈতিকতাহীন’ হয়ে পড়ব। আর স্মার্ট মানুষ নৈতিকতাহীন হলে সেটা হবে ভয়ংকর।

সর্বশেষ খবর