মঙ্গলবার, ১১ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

সংলাপ সমঝোতা চান সিইসি

নিজস্ব প্রতিবেদক

সংলাপ সমঝোতা চান সিইসি

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, অবাধ-নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ-সমঝোতার প্রয়োজন রয়েছে। গতকাল নির্বাচন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে নির্বাচন কমিশনের সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত সাংবাদিকদের সংগঠন ‘আরএফইডি টক’-এ তিনি এ কথা বলেন।

‘আরএফইডি টক’-এ উপস্থিত ছিলেন ইসি সচিব শফিউল আজিম ও অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ। সংগঠনের সভাপতি একরামুল হক সায়েমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবির। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে কোনো পরামর্শ আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমার নৈতিকতার অবস্থান থেকে উদাত্ত আহ্বান- আপনারা বৈরিতা কমিয়ে কিছু মৌলিক প্রশ্নে সমঝোতায় উপনীত হওয়ার চেষ্টা করুণ। মৌলিক প্রশ্ন এই নয় যে, আমাকে এতটা আসন দিতে হবে। মৌলিক প্রশ্ন আপনারা সবাই বোঝেন। গণতন্ত্র কাকে বলে। নির্বাচন কাকে বলে। তিনি বলেন, নির্বাচনকে অবাধ-নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করতে হয়। তাহলে আমার মনে হয়, এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ, সৌহার্দ্য এবং সমঝোতার প্রয়োজন আছে। কিন্তু সংসদ নির্বাচনের পাঁচ মাস চলে যাওয়ার পরও সে লক্ষ্যে কোনো উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না।

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে এখনই আলোচনা করা দরকার কি না প্রশ্নে সিইসি বলেন, আমরা তো আর নির্বাচন করব না। আমরা আমাদের উপলব্ধিগুলো লিখিতভাবে দিয়ে যাব। বিএনপিকে বুঝতে হবে। আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে। জাতীয় পার্টিকে বুঝতে হবে। তারা যদি শেষ পর্যন্ত মীমাংসা না করেন তাহলে এ অচলাবস্থা আরও ১০০ বছর চলবে? এ সংকট তো নিরসন হতে হবে। আমি দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে মনে করি এ সংকটের নিরসন হওয়া উচিত।

সিইসি বলেন, আমি বিশ্বাস করি রাজনীতিবিদরা যথেষ্ট প্রজ্ঞাবান, তাদের জ্ঞান, বিদ্যাবুদ্ধি, প্রজ্ঞা আছে। তারা সেই অবস্থান থেকে একটা না একটা সময় নিজেরা উপলব্ধি করে বিরাজমান সংকট নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। ইসির প্রতি আস্থাহীনতার বিষয়ে সিইসি বলেন, আস্থা একদিনে গড়ে উঠবে না। পর্যায়ক্রমে এটা গড়ে উঠবে। আমারা যে নির্বাচনগুলো করেছি, এতে জনগণের মধ্যে আস্থা অতীতের চেয়ে সীমিত পরিসরে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভোট জালিয়াতি কম হয়েছে।

বিরোধীদলগুলোর ভোট বর্জনের কারণ কী- জানতে চাইলে সিইসি বলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অনকূল ছিল না। একটা মোটাদাগে বিতর্ক হয়ে, সেটা এখনো বহাল আছে যে, অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজন। এটা একটা প্রশ্ন। এ বিষয়ে হাই কোর্টের রায় রয়েছে, নানা বিষয়ে রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে দেশের অন্যতম একটা প্রধান দল বলে, আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব না। এতে প্রত্যাশিত যে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, তার ঘাটতি ছিল। যেকোনো কারণেই হোক উভয়পক্ষ অনড় ছিল তাদের দাবি নিয়ে। যে কারণে একটি বড় দল অংশগ্রহণ করেনি। সেটা আমাদের বিষয় নয়। আমাদের কোনো ঘাটতি ছিল না, আমরা আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছিলাম।

নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংকট প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকেই সংলাপের মধ্য দিয়ে এর সমাধান করতে হবে। পরাজয় মেনে নিয়ে বিজয়ী দলকে অভিনন্দন জানানোর মাধ্যমে একটি সুস্থ নির্বাচনি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। আর যারা নির্বাচিত হবেন তারা সেবার মনোভাব নিয়ে জনগণের কাছে গেলে সংস্কৃতিতে বড় ধরনের একটি পরিবর্তন হবে। সংকট সমাধানে সংলাপের প্রয়োজন, এর উদ্যোগ কে নেবে- এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলব না। আমাদের দেশের যারা বিশিষ্টজন আছেন, তারা আমাদের চেয়ে ভালো বোঝেন কীভাবে সংলাপের উদ্যোগ নিতে হবে।

ভোটের পরিবেশ তৈরি করতে পারেননি, এ দায় আপনাদের ওপর দেওয়া হয়, এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, নির্বাচন কমিশনের কাজ নির্বাচন করা। ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। নির্বাচন কমিশনের একটি কাজ হচ্ছে তফসিল ঘোষণা করা। এরপর প্রতীক বরাদ্দ করা হয়, তখন বলে দেওয়া হয় তোমরা প্রচারণা করো। প্রচারণাটা সিইসি মাঠে গিয়ে করেন না। যারা পার্টি তারাই করেন। তাদের প্রচারণা ও দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল করবে ভোটার উপস্থিতি। ভোটার উপস্থিতি পুরোপুরি নির্ভর করে প্রার্থীর ওপর। ভোটার উপস্থিতির হার কত হবে, তার দায় আমরা নিতে পারব না। মনে রাখতে হবে নির্বাচনটা রাজনীতি নয়। নির্বাচন কমিশন একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে।

জনগণ বা ভোটারদের আস্থা কোন পর্যায়ে আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইসির যে সুযোগ ছিল, ইসির যে কাজগুলো করতে হবে এটার একটি রুটিন আছে, সেগুলো আমরা করে থাকি। এ ছাড়া ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য আমরা নানান রকম প্রচারণা করছি। একটি নির্বাচনের রাজনীতিবিদ ও প্রার্থীদের মধ্যে যে গণসংযোগ, আমি কিন্তু এবার তার কমতি দেখেছি। আমি বলব নির্বাচনের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিবেশটা যদি অনুকূল হয়ে ওঠে তাহলে মানুষের আগ্রহ আরও বাড়তে পারে। সিইসি আরও বলেন, আমরা নির্বাচনটাকে নিরপেক্ষভাবে আয়োজন করার চেষ্টা করছি কি-না, জনগণ দেখছে। আমরা কোনোরকম অসততার আশ্রয় গ্রহণ করিনি। কোনোরকম পক্ষপাতমূলক আচরণ করিনি এবং আমরা সৎ থেকে দায়িত্ব পালন করেছি। তাহলে জনগণের আস্থা না থাকলেও আস্থা হওয়া উচিত। আর আস্থা জিনিসটা একদিনে গড়ে ওঠে না। ক্রমান্বয়ে তা পরিণতি হতে পারে। আমরা যে নির্বাচনটা করেছি, এতে জনগণের মধ্যে আস্থা অতীতের চেয়ে সীমিত পরিসরে বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ সহিংসতা কম হয়েছে, ভোট জালিয়াতি কম হয়েছে, কারচুপি কম হয়েছে। ম্যানুপুলেশনের অভিযোগ হয়নি।

নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে এনআইডি চলে যাওয়া বিষয়ে সিইসি বলেন, এনআইডি আমাদের বিষয় নয়। আমাদের বিষয় ছিল ভোটার আইডি। সেটা করতে গিয়ে এনআইডি তৈরি করে ফেলেছি। যেটা দেশের জন্য জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এনআইডি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আইন হয়েছে। এটা রাষ্ট্রের ব্যাপার। আইন করে যদি বলা হয়, নির্বাচনের দায়িত্ব স্বারষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাবে। তবে আমি পদত্যাগ করব। ইভিএম সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রযুক্তির দিক দিয়ে আমাদের এগোতে হবে। আমার বিশ্বাস ছিল এটাতে ভূত আছে, এভাবে বা ওভাবে দিলে ভোট চলে যায় অন্য জায়গায়। দীর্ঘ দুই বছর ধরে এটি নিয়ে কাজ করছি। ইভিএম প্রযুক্তিতে এ ধরনের কোনো সুযোগ নেই। ইভিএম কিন্তু ডেমোক্রেসিকে এগিয়ে নিতে অনেক বেশি সহায়ক হবে।

ইভিএম কী হবে আমি জানি না। তবে আমার এবং আমার সহকর্মীদের সুপারিশ থাকবে ইভিএমের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে দেওয়া, জনগণের আস্থা ইভিএমের ওপর ফিরিয়ে আনা।

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি, এমন অভিযোগ কোনো ভোটার করেননি। দেশের সার্বিক নির্বাচন ব্যবস্থার আরও সংস্কার করা প্রয়োজন। এতে ব্যক্তির গুরুত্ব কমে যাবে, নির্বাচনব্যবস্থা আরও সুসংহত হবে। একটি বড় রাজনৈতিক দলের ভোটে না থাকায় অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হয়নি। তবে এখানে আমাদের করার কিছুই ছিল না।

তিনি বলেন, আমার কথা হচ্ছে আমি ভোট নিশ্চিত করব। তারা (বিএনপি) যদি নির্বাচনে আসত। তাহলে সেই প্রশ্ন করতে পারতেন যে, আমরা অংশগ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু ভোট টোটালি ফেল করেছে। আমাদের একজনও জয়লাভ করতে পারেনি। ২৯৯ আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেছে। একটি আসনে সবাই মিলে জয়লাভ করেছে। এমন হলে তখন দায়ভার আমাদের বহন করতে হতো কি না, তখন দেখতে পারতাম।

সিইসি প্রশ্নোত্তর পর্বের আগে বলেন, এবারে উপজেলা নির্বাচন অনেকটাই সহিংসতামুক্ত হয়েছে। অতীতের চেয়ে নির্বাচনি সহিংসতা অনেকটা কমেছে। দেশের রাজনীতি থেকে নির্বাচনটা বিচ্ছিন্ন না। রাজনীতিতে কিছু সংকট এখনো রয়েছে। নির্বাচনে বিভিন্নভাবে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। এটা দীর্ঘকাল থেকে হয়ে আসছে। এগুলোকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছি। সিইসি বলেন, দেশের সার্বিক নির্বাচনব্যবস্থার আরও সংস্কার ও উন্নয়ন প্রয়োজন। তবে কীভাবে সংস্কার হবে; উন্নয়ন হবে সেটা বলতে পারব না। এটা নিয়ে আলোচনা, গবেষণা, মতবিনিময়ের প্রয়োজন আছে। তিনি বলেন, আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পরেই একটি বড় রাজনৈতিক বিতর্কে পড়ে গিয়েছিলাম। নির্বাচন হবে কি হবে না? ইসির নিয়োগ বাতিল হয়ে যাবে ইত্যাদি নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। অস্থিরতা ছিল। নির্বাচন প্রশ্নে দেশের রাজনৈতিক সংকট যেটা ছিল, সেটা এখনো রয়েছে দেখতে পাচ্ছি। রাজনৈতিক সংকট ও বিতর্ক সুষ্ঠু নির্বাচনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলতে পারে। রাজনৈতিতে বৈরিতা বিতর্ক থাকতে পারে।

 

আজিজ আহমেদের ভাইদের এনআইডি জালিয়াতি তদন্তে কমিটি

‘মিথ্যা তথ্য’ দিয়ে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের দুই ভাইয়ের জাতীয় পরিচয়পত্র নেওয়ার অভিযোগ তদন্তে কমিটি করার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। সিইসি বলেন, আজিজ সাহেবের ভাই-বোন, বঙ্গবন্ধুর খুনি মোসলেম উদ্দিনের পরিবার ভুল তথ্য দিয়ে এনআইডি করেছে জেনেছি। ২০-২৫ বছর পর হঠাৎ জানা গেল। এখন দুটো তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। সিইসি বলেন, অপরাধ জানার পরও অপরাধ হচ্ছে। যিনি পাঁচটি (একাধিক) এনআইডি করেছেন, তিনি অপরাধ করেছেন। কোনো না কোনো ফাঁক-ফোকরের সুযোগে অপরাধ করেছেন। কিন্তু তিনি (যিনি অপরাধ করেন) যে নির্মল ব্যক্তিত্ব, সেটা বলছি না, কোনো সাফাই করি না। তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কভিডের সময় রিপোর্ট জালিয়াতি ও সাম্প্রতিক সময়ে কারিগরি বোর্ডের সার্টিফিকেট জালিয়াতির প্রবণতার বিষয়টি তুলে ধরেন সিইসি। তিনি বলেন, এনআইডির একটা প্রযুক্তিগত দিক রয়েছে। এ প্রযুক্তির ফাঁক-ফোকর থাকতে পারে। একটা জিনিসের ৯৯.৯৯ শতাংশ লোক সুবিধা পেয়ে থাকে, ০.০১ শতাংশ লোক যদি এর অপব্যবহার করে; তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

এনআইডি জালিয়াতিতে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পাওয়া ডেটা অ্যান্ট্রি অপারেটরদের দায় থাকতে পারে বলে মনে করেন সিইসি। তিনি বলেন, স্থায়ী চাকরি করে তারা নয়, ডেটা অ্যান্ট্রি অপারেটররা হয়তো প্রলুব্ধ হয়ে, লোভের বশবর্তী হয়ে কিছু কিছু কাজ করেছে। ব্যাপকভাবে হয়েছে তা কিন্তু নয়।

জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা প্রদানে নাগরিকদের হয়রানি, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার যেন না হয়, তা নিশ্চিত করতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। এ ছাড়া সময়মতো সেবাদানেরও নির্দেশনা দেন তিনি।

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ পাঁচ ধাপে সার্বিকভাবে ৩৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর