বুধবার, ১২ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

আসছে আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম

বিশেষ প্রতিনিধি ঢাকা, ঝিনাইদহ ও কলকাতা প্রতিনিধি

আসছে আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম

এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার তদন্তে নতুন মোড় নিয়েছে। আলোচিত এই খুনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ঝিনাইদহের প্রভাবশালী নেতা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে আটক করেছে পুলিশ। গতকাল বিকাল ৪টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে তাকে আটক করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাঞ্চল্যকর এ খুনের পেছনে শুধু       চোরাচালানই নয়, রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। খুনের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন এমন আরও কয়েকজন প্রভাবশালীর নাম বেরিয়ে এসেছে তদন্তে। যে কোনো মুহূর্তে তাদের গ্রেফতার করা হবে। গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যেই রয়েছেন সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা। এদিকে সেপটিক ট্যাঙ্কি থেকে উদ্ধার করা মাংসের টুকরা পুরুষ মানুষের। কলকাতায় ফরেনসিক রিপোর্টে এ তথ্য জানতে পেরেছে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি। ডিএনএ টেস্টের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে, মাংসগুলো এমপি আনারের কি না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত তিন দিনে আনার খুন রহস্যের তদন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়েছে। বিশেষ করে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুুর কাছ থেকে আনার খুনের চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। রিমান্ডে ব্যাপক জেরার মুখে গ্যাস বাবু ফাঁস করেছে যশোর এবং ঝিনাইদহের প্রভাবশালী কয়েকজনের নাম। এদের মধ্যে অন্যতম ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর নামও রয়েছে। এসব ব্যক্তির কাছে আনারের লাশের ছবি কলকাতা থেকেই সরবরাহ করা হয়েছিল। শিমুল ভূঁঁইয়া কলকাতা থেকে টুকরা করার আগে লাশের ছবি সরবরাহ করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত সোমবার বলেছেন, তদন্ত শেষ হলে আরও অনেকেই গ্রেফতার হতে পারেন। আমরা সত্যের কাছাকাছি এসে গেছি। গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, আনার হত্যায় অন্যতম অভিযুক্ত আক্তারুজ্জামান শাহিনের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিন্টুর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তাকে আটকের পর সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয়েছে ডিবি কার্যালয়ে।

ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ জানান, আনার হত্যা মামলা তদন্তে আরও অগ্রগতি হয়েছে। আরও কয়েকজনের সংশ্লিষ্টার বিষয়ে তথ্য পেয়েছি। তারা নজরদারিতে রয়েছে। সময় হলেই গ্রেফতার করা হবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র বলছে, হত্যাকান্ডের ঘটনায় গ্রেফতার চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁঁইয়ার জবানবন্দিতে ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন নেতার নাম সামনে এসেছে। এরপরই অনেককে গ্রেফতারে নেমেছে পুলিশ।

এদিকে আটকের খবর প্রকাশিত হওয়ায় ঝিনাইদহ রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল আজিম আনার ভারতের সঞ্জীভা গার্ডেনসে নৃশংস খুন হওয়ার ২৮ দিন পর হত্যার ঘটনার নতুন মোড় নিয়েছে। ঝিনাইদহ গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় ঝিনাইদহ জেলার আরও চার থেকে পাঁচজন গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন। যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতার করা হতে পারে। আরও জানা গেছে, আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাে র মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহিনের মামাতো ভাই ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবুর সঙ্গে ৩ কোটি টাকার সমঝোতা হয়। আনারের পরিবারের পক্ষ থেকে নিহত এমপির কন্যা মুনতারিন ফেরদৌস ডরিন ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের প্রেক্ষাপটে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল বাবুকে গ্রেফতার-পরবর্তী তাকে রিমান্ডে আনা, রিমান্ড চলাকালীন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে গোয়েন্দা পুলিশের আটকের পর ঘটনাটি নতুন নতুন তথ্যের জন্ম দিচ্ছে।

সূত্রের দাবি, আক্তারুজ্জামান শাহিনের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের যোগাযোগ ছিল। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সফিকুল ইসলাম অপু গণমাধ্যমকে বলেন, ওই নেতার আটক হওয়ার কথা শুনেছি। আমাদের জনপ্রিয় এমপি আনার হত্যাকাে র সঙ্গে যেই জড়িত থাকুক না কেন, আমরা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। অন্যদিকে, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর ঝিনাইদহের বাড়িতে ও ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এর আগে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু গ্রেফতার হচ্ছেন এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে ঝিনাইদহসহ সারা দেশে। তবে গত কয়েক দিন তাকে প্রকাশ্যে দেখা না গেলেও তিনি গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রিমান্ডে শিমুলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হত্যা মিশন বাস্তবায়নের পর তাকে ২ কোটি টাকা দেওয়ার কথা ছিল কাজী কামাল আহমেদ বাবুর। আর বাবুর পেছনে ছিলেন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা সাইদুল করিম মিন্টু। শিমুলের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারে গোয়েন্দারা বাবুর সস্পৃক্ততা নিশ্চিত করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সব বিষয়ে দেখভাল করতেন জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু। এমপি আনারের পরিবারের দাবি, এ হত্যাকাে র পেছনে রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষ জড়িত। ২০১৭ সালেও বিরোধী পক্ষ এমপি আনারকে হত্যাচেষ্টা করে। সে ঘটনায় থানায় মামলা হয়, আসামিরাও সব স্বীকার করে। তবে মামলাটি পরে মীমাংসা করা হয়। আনারের ছোট ভাই এনামুল হক ইমান অভিযোগ করেন, গ্রেফতার বাবুর ডানহাত নামে খ্যাত জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিন্টু। এ ছাড়া হত্যার মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহিনেরও ঘনিষ্ঠ এই মিন্টু। গত সংসদ নির্বাচনে আনারের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন আবদুর রশীদ খোকন। খোকনের পক্ষে কাজ করেন সাইদুল করিম মিন্টুসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মী। তারা এক জনসভায় প্রকাশ্যে বক্তব্য দেয় বঙ্গের মাটিতে জায়গা হবে না আনারের। মিন্টু নির্বাচন ছাড়া টানা ১২ বছর মেয়র ছিলেন। মেয়র পদ হারানোর পেছনে আনারকে দায়ী করে আসছিলেন মিন্টু।

উদ্ধারকৃত মাংস পুরুষ মানুষের : কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীভা আবাসনের সেফটি ট্যাংক থেকে উদ্ধার হওয়া মাংসের টুকরো পুরুষ মানুষের। ফরেনসিক পরীক্ষার পর প্রাথমিক রিপোর্টে এ তথ্য জানতে পেরেছে সিআইডি। যদিও চূড়ান্ত রিপোর্টের অপেক্ষায় রয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা।

গত ২৮ জুন সঞ্জীভা আবাসনের বিইউ-৫৬ ব্লকের সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার হয় প্রায় চার কেজি মাংস। উদ্ধারকৃত ওই মাংস মানুষের কি না তা পরীক্ষার জন্য নমুনা পাঠানো হয়েছিল ‘সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি’তে। প্রাথমিক রিপোর্ট বলছে, ওই মাংস মানুষের। কিন্তু সেই খন্ডবিখন্ড লাশ এমপি আনারের কি না তা জানতে এবার ডিএনএ পরীক্ষা করতে চায় তদন্তাকারী কর্মকর্তারা এবং এ লক্ষ্যে আদালতের দ্বারস্থ হতে চলেছে সিআইডি। আদালতের অনুমতি পেলেই এমপি আনারের কন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন এবং রক্তের সম্পর্ক থাকা অন্য ব্যক্তিদের ডেকে তাদের শরীরের নমুনা সংগ্রহ করা হবে। সিআইডির এক কর্মকর্তা জানাচ্ছেন এর জন্য আমাদের কূটনৈতিক অনুমতিও প্রয়োজন। একেবারে শেষ ধাপে ডিএনএ ম্যাচিংয়ের জন্য এমপি আনার কন্যার ভারতে আসার প্রত্যাশায় আমরা রয়েছি। এদিকে মাংসের টুকরো ও হার উদ্ধার হলেও এখনো খোঁজ নেই সংসদের মাথার খুলির কিংবা খুন ব্যবহার করা অস্ত্রের। সিয়াম জানিয়েছে তারা একটি গাড়ি ভাড়া করে কৃষ্ণমাটিতে এসে টলি ব্যাগ থেকে হাড় এবং মাথার অংশ ব্যাগ তুলে খালের মধ্যে ছুড়ে দিয়েছিল। গোয়েন্দাদের দাবি- আরও কয়েক দফায় নৌবাহিনী সদস্যদের দিয়ে তল্লাশি করা হবে খাল। সিআইডি জানাচ্ছে তাদের পরবর্তী লক্ষ্য এই খুনের ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার করা।  শিলাস্তির জামিন নামঞ্জুর : ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলায় গ্রেফতার শিলাস্তি রহমানের জামিন নামঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল ইসলামের আদালতে তার আইনজীবী জামিনের আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। এর আগে এ মামলায় গত ৩ জুন আদালতে জবানবন্দি দেন আসামি শিলাস্তি রহমান।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর