বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

আলোচনায় রাঘববোয়ালদের নাম

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা ও ঝিনাইদহ প্রতিনিধি

আলোচনায় রাঘববোয়ালদের নাম

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার খুনের তদন্তে বেরিয়ে আসছে রাঘববোয়ালদের নাম। আলোচনায় রয়েছে রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে চোরাকারবারিদের নামও। যশোর অঞ্চলের আওয়ামী লীগের আরেকজন প্রভাবশালী নেতার নামও উঠে এসেছে তদন্তে। তাদের মধ্যে একজন রয়েছেন যিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে পরাজয় বরণ করেন। এরা প্রত্যেকেই রয়েছেন গোয়েন্দা নজরদারিতে। আনার খুনের তদন্ত করতে গিয়ে এর নেপথ্য কারণ হিসেবে সোনা চোরাচালান ছাড়াও রাজনৈতিক কারণও খুঁজে পাচ্ছেন গোয়েন্দারা। আনারকে হত্যার পর এদের সঙ্গে শিমুল ভূঁইয়ার নানাভাবে যোগাযোগ হয়েছে। মোবাইল ফোনে মেসেজ আদানপ্রদান করা হয়েছে। এসব তথ্য-উপাত্তের সূত্র ধরেই পুলিশ তদন্তকাজ এগিয়ে নিচ্ছে। ডিবি কার্যালয়ে গতকাল দিনভর জেরা করা হয় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (গোয়েন্দা) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, আমরা যখন কাউকে নিয়ে আসি অবশ্যই কিছু তথ্য-উপাত্ত থাকে। প্রমাণের ভিত্তিতেই তাকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করি।

এদিকে এমপি আনার হত্যার বিচার কোনো চাপে যেন বন্ধ না হয়-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সেই দাবি জানিয়েছেন এমপি আনারের কন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। তিনি অভিযোগ করেন, জড়িতদের ছাড়িয়ে নিতে তদবির হচ্ছে। বড় বড় জায়গা থেকে ফোন আসছে।

যে কারণে গ্রেফতার বাবু-মিন্টু : খুনের পরপরই ঝিনাইদহের একাধিক নেতার মোবাইলে ‘মিশন সফল’ জানিয়ে আক্তারুজ্জামান শাহিন খুদে বার্তা পাঠান বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। হত্যাকান্ডের পর সঞ্জীভা গার্ডেন  থেকে শিমুল ভূঁইয়া শাহিনের মোবাইলে ছবি পাঠান। যেসব ছবি শাহিন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিন্টু এবং ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহম্মদ বাবুর মোবাইলে পাঠিয়ে বলেন, ‘আনার শেষ, মনোনয়ন কনফার্ম’। ঘটনাটি শিমুল ভূঁইয়ার স্বীকারোক্তিতে উঠে আসায় গত রবিবার রাতে ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহম্মদ বাবুকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তার তথ্যের ভিত্তিতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে আটক করা হয়।

সূত্র জানায়, এমপি আনার ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে চেয়েছিলেন। এমনকি সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এমপি আনারের সঙ্গে মিন্টুর প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কিন্তু মনোনয়ন থেকে মিন্টু ছিটকে গিয়ে কালীগঞ্জে আনারবিরোধী শিবির গড়ে তোলেন। ওই শিবিরে আবদুর রশীদ খোকন নামের একজনকে দিয়ে মিন্টু স্বতন্ত্র নির্বাচন করান। কিন্তু সেই নির্বাচনে আনারের কাছে পরাজিত হয়। এতে মিন্টুসহ জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বছর দেড়েক আগে আক্তারুজ্জামান শাহিনের সঙ্গে মিন্টুর সুমধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সম্পর্ক কাজে লাগান।

সূত্র আরও জানায়, মিন্টু ছাড়াও এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে বেরিয়ে আসছে রাঘববোয়ালদের নাম। মিন্টুর সঙ্গে তারাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে সোনা চোরাচালান, মাদক পাচার, হুন্ডি ব্যবসায়ীরা যাদেরকে নিরাপত্তা দিয়ে আসছিলেন একাধিক প্রভাবশালী এমপি। এসব এমপি মনোনয়ন বাণিজ্যের সঙ্গেও জড়িত বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

মিন্টুকে জেরা : আনার হত্যাকান্ডের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে দিনভর জেরা করা হয় মিন্টুকে। ডিবির তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হত্যাকান্ডের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। সে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে মিন্টু যদি কোনো সদুত্তর দিতে না পারেন তাহলে তাকে গ্রেফতার দেখানো হবে। গতকাল পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, কাজী কামাল আহম্মদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুর কাছে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণের পরই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাইদুল করিম মিন্টুকে ডাকা হয়েছে। মিন্টুর কাছে তথ্যগুলো জানতে চাওয়া হচ্ছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যদি মিন্টু সদুত্তর দিতে পারেন তবে তাকে ছেড়ে  দেওয়া হবে। আর যদি কোনো প্রশ্নের সদুত্তর দিতে না পারেন তবে তদন্তের ধারাবাহিকতায় যা করার তাই করা হবে।’ মিন্টুকে গ্রেফতার না  দেখিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবিপ্রধান বলেন, ‘আমাদের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হত্যাকান্ডের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। সে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে মিন্টু যদি কোনো সদুত্তর দিতে না পারেন, তদন্ত কর্মকর্তা তখনই আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।’ তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বাবুকে নিয়ে আসি। আমরা যখন কাউকে নিয়ে আসি অবশ্যই কিছু তথ্য-উপাত্ত থাকে। প্রমাণের ভিত্তিতেই তাকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করি। জিজ্ঞাসাবাদে গ্যাস বাবু অকপটে স্বীকার করেন যে, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়া ঘাতক শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছিলেন। শিমুল ভূঁইয়া গ্যাস বাবুকে এমপি আনার হত্যার পর ছবি দেখিয়েছেন। তদন্ত কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে সব মামলার ঘটনা তদন্ত করেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের ওপর কোনো চাপ প্রয়োগ করে না। কারণ তারা জানে ডিবির সব চৌকশ টিম মামলার তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধী দেশে কিংবা বিদেশে থাকলেও তাদেরকে খুঁজে বের করে আনে। কোনো নিরীহ লোককে হয়রানি করার প্রশ্নই আসে না।’

ডরিনের অভিযোগ : এমপি আনার হত্যার বিচার কোনো চাপে যেন বন্ধ না হয়- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সেই দাবি জানিয়েছেন আনারের কন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। সাক্ষাতের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি আসলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এজন্য এসেছি যে, আমার বাবা যে হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন, সেটার যাতে সঠিক বিচার হয়। সঠিক বিচারটা যাতে আমাকে নিশ্চিত করেন, সেই দাবি জানাতে। তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এরই মধ্যে অনেককে আটক করা হয়েছে। আমি শুনেছি, অপরাধীদের বাঁচাতে অনেক জায়গা থেকে তদবির করা হচ্ছে। তাদের যেন ছেড়ে দেওয়া হয়, সেজন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।’ ‘কোনো তদবিরের চাপে পড়ে এই হত্যাকান্ডের বিচার যাতে বন্ধ করার চেষ্টা না হয়, চাপের মুখে যাতে সঠিক তদন্ত বন্ধ করা না হয়, সেই দাবি জানিয়েছি। আমি সঠিক বিচার চাই।’ এমপি আনারকন্যা বলেন, গ্যাস বাবু নামে যাকে আটক করা হয়েছে, তিনি আমার বাবার প্রতিপক্ষ নন। আমাদের সঙ্গে তার কোনো শত্রুতাও নেই। আমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে। গত ১৭ মে তার সঙ্গে ভাঙ্গায় দেখা হয়েছে, সেখানে টাকা লেনদেনের কথা উঠেছে, যা আমি খবরে শুনেছি।’ মুমতারিন ফেরদৌস বলেন, ‘আমার কথা হলো, এই টাকার জোগানদাতা কে? কেন তারা এটা করিয়েছে? আপনারা দেখেছেন, তাকে আটকের আগে থানায় তিনি জিডি করেছেন যে তার তিনটি ফোন হারিয়ে গেছে। একই দিনে একজন মানুষের তিনটি ফোন কীভাবে হারিয়ে যায়, সেটাও আমার প্রশ্ন। এগুলো কি পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে, সে তো আমার বাবার শত্রু নন। এই কাজগুলো কে করাচ্ছে, সেটা আমি বারবার বলেছি।’

বীভৎস ছবি ও নিউজ শেয়ার করে আবেগঘন স্ট্যাটাস : এমপি আনারকন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন পিতার বীভৎস ছবি ও নিউজ তার ভেরিফাই পেজে শেয়ার করে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। গতকাল রাত ৮টা ২০ মিনিটে তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ছবি ও নিউজ শেয়ার করেন। এতে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। ডরিন লিখেছেন- ‘আজকে আমার বাবার এই ছবি দেখা লাগতেছে। আমি পারছি না আমি পারছি না। আহারে আহারে এ কি নিষ্ঠুর কি নিষ্ঠুর। কি অসহায়ের মতো আমার বাবা কে বেঁধে রেখেছে। আমার বাবা অনেক কষ্ট পাচ্ছিল। আল্লাহ, আল্লাহ গো তুমি কোথায় তুমি এর বিচার করো বিচার করো। কতো কষ্ট দিলো কি অসহায়ের মতো বেঁধে রেখেছে। আর আপনারা বড় বড় কথা বলেন আমি ডরিন কাউকে ছাড়ব না।’ ডরিনের দেওয়া নিউজে যা যা উল্লেখ করা হয়েছে- সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের সঙ্গে কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীভা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটটিতে ঠিক কী ঘটেছিল, তা নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য ও ভিডিও আসে একটি টেলিভিশনের হাতে। ভিডিওতে দেখা গেছে, কসাই জিহাদ স্বীকারোক্তি দিয়ে জানাচ্ছে, বালিশচাপা দিয়ে আনারকে হত্যা করার পর ওই ফ্ল্যাটের বাথরুমে কীভাবে তার মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে ফ্ল্যাশ করা হয়। হত্যার পর সংসদ সদস্যকে বেঁধে রাখার চিত্রও প্রকাশ পেয়েছে ভিডিওতে। এতে দেখা যাচ্ছে, অজ্ঞান করার রাসায়নিক ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করে আনারকে বালিশচাপা দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি খুনিরা। মৃত আনারকে চেয়ারে বসিয়ে তার হাত ও পা শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়।

সর্বশেষ খবর