শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

কী হচ্ছে নাফ সীমান্তে

নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরে নাইক্ষ্যংদিয়া পয়েন্টে মিয়ানমারের যুদ্ধজাহাজ, লাগাতার গোলাগুলি, ছয় দিন ধরে চলছে না বাংলাদেশি নৌযান, সেন্টমার্টিনে বিকল্প পথে পণ্য ও মানুষ পারাপারের চিন্তা

আয়ুবুল ইসলাম, কক্সবাজার

কী হচ্ছে নাফ সীমান্তে

মিয়ানমারের যুদ্ধজাহাজ

কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে আলাদা একটি দ্বীপ সেন্টমার্টিন। বুধবার রাত ১০টা থেকে গতকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত উপজেলার নাফ নদের এপারের শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন ও আশপাশ এলাকায় ভারী অস্ত্র ও গোলা বিস্ফোরণের শব্দ একের পর এক ভেসে আসে। গত এক সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে অন্তত পাঁচ-ছয় বার গুলি ছুড়েছে সেন্টমার্টিনগামী নৌযানে। আতঙ্কে বন্ধ সেন্টমার্টিন-টেকনাফ নৌরুট। একদিকে খাদ্যসংকটের সঙ্গে প্রবালদ্বীপের প্রায় ১০ হাজার মানুষ, অন্যদিকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দে নাফ সীমান্তের               মানুষ। সীমান্তের নিকটবর্তী নাফে ভিড়ে আছে মিয়ানমারের যুদ্ধজাহাজ। দেশবাসীর প্রবল উৎকণ্ঠা-কী হচ্ছে নাফ সীমান্তে?

সীমান্তের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বুঝতে পারছে না গুলি মিয়ানমার জান্তা, নাকি বিদ্রোহীরা করছে। ফলে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না তারা। এরই মধ্যে বুধবার মর্টার শেল ও ভারী গোলার বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন। এ কারণে সীমান্তের কয়েক গ্রামের আতঙ্কিত মানুষ নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে।

গতকাল দুপুরে সেন্টমার্টিন থেকে তিনটি ট্রলারে বিকল্প পথে টেকনাফে আসে ২ শতাধিক মানুষ। তবে মিয়ানমারের গোলাগুলির কারণে সেন্টমার্টিনবাসীর জন্য জেলা প্রশাসনের খাদ্যসামগ্রী বহনকারী নৌযান যেতে পারেনি বলে নিশ্চিত করেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী। তিনি জানান, বিকল্প পথে হয়তো আজ কক্সবাজার থেকে এ খাদ্যসামগ্রী সেখানে পৌঁছাতে পারে।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, কয়েকদিন ধরে হোটেল কর্মী, কাজ করতে আসা শ্রমিক এবং বিভিন্ন কাজে সেন্টমার্টিন এসে আটকে পড়া মানুষকে বিশেষ ব্যবস্থায় বিকল্প পথে ফেরানো হয়েছে টেকনাফে। সময় যত যাচ্ছে ততই অনিশ্চয়তা বাড়ছে দ্বীপের মানুষের। খাদ্যসহায়তা খুবই প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বুধবার নাফ নদের ওপারে মিয়ানমার সীমান্তে মৌলভীপাড়ার বিপরীতে দেখা মেলে একটি বড় আকারের যুদ্ধজাহাজ। জাহাজটিকে স্থানীয়রা মিয়ানমার নৌবাহিনীর বলে দাবি করছে। সারা দিন জাহাজটি সেখানেই অবস্থান করেছে। রাত ৯টা থেকে এপারে ভেসে আসতে থাকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। এরপর থেমে থেমে শব্দ শোনা গেছে রাতভর। গতকাল সকালে জাহাজটি দক্ষিণ দিকে সরে গিয়ে টেকনাফের নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরের নাইক্ষ্যংদিয়া পয়েন্টে অবস্থান করতে দেখা গেছে। আর সেই জাহাজ থেকে মিয়ানমারের স্থলভাগে থেমে থেমে গোলাগুলি ও মর্টার শেল বর্ষণের শব্দ অব্যাহত রয়েছে।

উপজেলার সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আবদুস সালাম বলেন, কয়েক দিন ধরে নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগর মোহনার মাঝামাঝি সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাতায়াতকারী নৌযান লক্ষ্য করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নাইক্ষ্যংদিয়া থেকে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটছে। তাতে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও আতঙ্কে নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কে বা কারা গুলি ছুড়ছে, তা-ও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।

ইউপি সদস্য আবদুস সালাম আরও বলেন, শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তের নাফ নদের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের আশপাশের মেগিচং, কাদিরবিল, নুরুল্লাহপাড়া, মাঙ্গালা, নলবইন্ন্যা, ফাদংচা ও হাসুরাতা এলাকা। ধারণা করা হচ্ছে, মংডু শহর ও আশপাশ এলাকাগুলোয় দেশটির সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে লড়াই তীব্র হয়ে উঠেছে। তাতে উভয় পক্ষ ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করায় বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যায়। সীমান্তের একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত চলছে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির। ইতোমধ্যে বিদ্রোহীরা রাখাইনের অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। দুই পক্ষের গোলাগুলি ও ভারী গোলার বিস্ফোরণে মংডু, বুচিডং-রাচিডং টাউনশিপ লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে। এসব শহরের সঙ্গে রাখাইনের রাজধানী সিথুয়ের সরাসরি সড়ক ও নৌ পথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্রোহীরা রাজধানীর দখল নিতে অগ্রসর হচ্ছে।

সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ছিদ্দিক আহমদ বলেন, বুধবার রাত ১০টা থেকে গতকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত একের পর এক বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা গেছে। টেকনাফ পৌরসভা, সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, হ্নীলা ও হোয়াইক্যং সীমান্তের ওপারে রাতভর যুদ্ধ চলেছে। বিস্ফোরণের ভয়াবহতার বিবরণ দিয়ে শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা আবদুর রহমান বলেন, বিকট শব্দে যেন টেকনাফ উড়ে যাচ্ছে। এমন বিস্ফোরণের শব্দ আগে কখনো শুনিনি। একেকটি গোলার শব্দে পুরো গ্রাম কেঁপে উঠেছে। আতঙ্কে কেউ ঘুমাতে পারেনি। টেকনাফ সদরের কেরুনতলীর বাসিন্দা লালু মিয়াও রাতভর বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনেছেন। তিনি বলেন, সকালেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। সাবরাংয়ের পানের বরজের মালিক ফকির মিয়া বলেন, রাত থেকে সকাল পর্যন্ত গোলাগুলির পাশাপাশি শতাধিক বিস্ফোরণের শব্দ হয়েছে। টেকনাফ সদর ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান জিহাদ বলেন, নাফ নদের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন পর আবারও প্রচ- গোলাগুলি ও বিস্ফোরণ শুরু হয়েছে। এতে সীমান্তের বাসিন্দারা আতঙ্কে আছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আদনান চৌধুরী বলেন, বুধবার রাত থেকে টেকনাফে প্রচ- গোলাগুলির শব্দ আসছে। আমরা এ বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সজাগ রয়েছে। এ বিষয়ে টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, সীমান্তে টহল জোরদারের পাশাপাশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি।

এরই মধ্যে ৫ জুন সেন্টমার্টিন থেকে ফেরার সময় নির্বাচনি সরঞ্জাম ও কর্মকর্তাদের বহনকারী নৌযানে গুলি ছোড়া হয় মিয়ানমার থেকে। এতে ট্রলারটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কেউ হতাহত হয়নি। এরপর ৮ জুন পণ্যবাহী ট্রলারে আবারও গুলি করা হয়। এতে কেউ হতাহত না হলেও ট্রলারটিতে সাতটি গুলি লাগে। গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার এ রুটে চলাচলকারী একাধিক ট্রলার লক্ষ্য করে মিয়ানমার থেকে গুলি চালানো হয়। নাফ নদের মোহনায় এ ঘটনাগুলো ঘটে। এর পর থেকে সেন্টমার্টিনের পথে কোনো নৌযান ছেড়ে যায়নি। সর্বশেষ মঙ্গলবার (১১ জুন) সকালে বাংলাদেশি স্পিডবোট লক্ষ্য করে মিয়ানমার থেকে গুলি চালানো হয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি) নাকি বিদ্রোহী আরাকান আর্মি গুলি চালিয়েছে, তা কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি।

সর্বশেষ খবর