শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

মিন্টুকে ঘিরে অপার রহস্য

বিশেষ প্রতিনিধি

মিন্টুকে ঘিরে অপার রহস্য

এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকান্ডে অন্যতম মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহিনের পক্ষে কাজ করেন মূল হত্যাকারী শিমুল ভুঁইয়া। ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর পক্ষে কাজ করেছেন ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু। হত্যাকান্ডের আগে ও পরে বাবুর সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছেন এবং দেখা করেছেন খুনি শিমুল ভুঁইয়া। আনারের লাশের ছবিও এ সময় সরবরাহ করা হয়। পুরো ঘটনার আড়ালে ছিলেন সাইদুল করিম মিন্টু। শুধু যোগাযোগ রেখেছেন গ্যাস বাবুর সঙ্গে। অর্থ লেনদেনের বিষয়টিও তিনি সরাসরি না করে গ্যাস বাবুর মাধ্যমেই করার চেষ্টা করেছেন। যে কারণে মিন্টুকে ঘিরেই এখন অপার রহস্য। মিন্টুর ওপরে আর কেউ আছে কি না, পুলিশের দৃষ্টি সেদিকেও রয়েছে। আনার নিখোঁজের পর রাষ্ট্রের শীর্ষ থেকে সর্বমহলে যখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছিল, সেই সময়ে মিন্টু পুরো ঘটনা জানলেও কেন পুলিশকে জানালেন না, এ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন গোয়েন্দারা। কিন্তু এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি মিন্টু। আর এই রহস্যের ভিতর-বাইর জানতে গোয়েন্দারা এখন ভীষণ তৎপর। মিন্টুকে গতকাল আট দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। গোয়েন্দা দফতরে আজই বাবুর মুখোমুখি করা হবে। মুখোমুখি জেরা করতে প্রয়োজনে ফের শিমুল ভুঁইয়াকে রিমান্ডে নেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে। এ ছাড়া আখতারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে কলকাতায় আরেকজন বাংলাদেশি নারী ছিলেন। যিনি একজন মডেলও। গোয়েন্দারা সেই মডেলকেও খুঁজছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, আনার হত্যাকান্ডের মোটিভ রাজনৈতিক ক্ষমতার দিকে মোড় নেওয়ার পর প্রতিদিনই নিত্যনতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। সেই সঙ্গে দৃশ্যমান হচ্ছে এ হত্যাকান্ডের নেপথ্য নায়কদের ভূমিকা। এর মধ্যে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে আক্তারুজ্জামান শাহিনের পর অর্থদাতা হিসেবে আলোচনায় আসা ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর সংশ্লিষ্টতাও দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমপি আনার পৃথিবীতে না থাকলে লাভ কার? তার স্বর্ণ পাচার সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দেবেন কে আর এমপির গদিতে কে বসবেন? এই হিসাব মিলিয়েছেন আক্তারুজ্জামান শাহিন ও আওয়ামী লীগ নেতা মিন্টু। কেননা আনার না থাকলে মনোয়ন পাবেন মিন্টু আর শাহিন হবেন চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের প্রধান।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মিন্টু যখন আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে হত্যার বিষয়ে আলোচনা করেন- তখন থেকেই নিজেকে আড়ালে রাখার চেষ্টা করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনোক্রমেই যাতে তার সংশ্লিষ্টতা বুঝতে না পারে সে জন্য শাহিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন রিমান্ডে থাকা তার ঘনিষ্ঠ আরেক আওয়ামী লীগ নেতা গ্যাস বাবুর মাধ্যমে। শাহিন কিলিং মিশনের নেতৃত্ব দেওয়া শিমুল ভুঁইয়াকে মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাজে নামান। কিলিং মিশন শেষ করে আসার পর ২৩ মে শিমুল ভুঁইয়াকে ২ কোটি টাকা দেওয়ার কথা ছিল মিন্টুর। কিন্তু তার আগেই ভাতিজা তানভিরসহ গ্রেফতার হয়ে যান শিমুল ভুঁইয়া। আক্তারুজ্জামান শাহিনও কয়েক ধাপে ৫ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিলেন শিমুল ভুঁইয়াকে। কিন্তু গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় সেই টাকাও আর হাতে পাননি কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া সদস্যরা। পুলিশের তদন্তকারীদের তথ্যমতে, কলকাতার সঞ্জীভা গার্ডেনসে খুনের আগে কলকাতা থেকে আক্তারুজ্জামান শাহিন ফোন করেন মিন্টুকে। সেই ফোনালাপেই আনার হত্যাকান্ডের চূড়ান্ত প্রস্তুতির কথা জানানো হয় তাকে। অন্যদিকে শাহিনের সঙ্গে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুর কথা হয় যে তিনটি মোবাইল ফোনে, সেই ফোনগুলো নিজ হেফাজতে নিয়ে নেন মিন্টু। এরপর ফোনগুলো হারিয়ে গেছে মর্মে থানায় জিডিও করেন গ্যাস বাবু। সূত্র জানায়, কিলিং মিশন শেষে দেশে আসার পর শিমুলের সঙ্গে গ্যাস বাবুকে বৈঠক করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মিন্টু।

এদিকে মিন্টু এমপি আনার হত্যাকান্ডের ঘটনায় অর্থদাতা ও নির্দেশদাতা ছিলেন কি না তা তদন্তে বের করা হবে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। গতকাল বিকালে নিজ কার্যালয়ে তিনি বলেন, কিলার শিমুল ভুঁইয়া ও গ্যাস বাবুর জবানবন্দিতে কিছু তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি। এ কারণে মিন্টুকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করি। পরে মিন্টুর আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ডিবিপ্রধান বলেন, সাইদুল করিম মিন্টুকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে তিনি হত্যাকান্ডের ঘটনা কতটুকু জানেন। গ্যাস বাবুর মোবাইল কেন নেওয়া হলো সেটিও জিজ্ঞাসা করা হবে। কিলার শিমুল ভুঁইয়া ঢাকায় আসার পর কেন মিন্টুর প্রতিনিধি গ্যাস বাবু তার সঙ্গে দেখা করলেন, জানতে চাওয়া হবে মিন্টুর কাছে। টাকা-পয়সার লেনদেন সঠিক কি না? গ্যাস বাবুর মোবাইল নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন কি না? এ ছাড়া আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে কথা বলেছেন কি না? সবকিছু মিন্টুর কাছে জানতে চাওয়া হবে বলে জানান হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, রিমান্ডে গ্যাস বাবু স্বীকার করেছেন, আনার হত্যাকান্ডের মূল ঘাতকের সঙ্গে মিটিং এবং একাধিকবার দেখা করেছেন তিনি। আক্তারুজ্জামান শাহীনের পক্ষে কাজ করেছেন শিমুল ভুঁইয়া, অন্যদিকে সাইদুল করিম মিন্টুর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন গ্যাস বাবু। জিজ্ঞাসাবাদে বাবু জানান, মিন্টুর বুদ্ধিতে মোবাইল মিন্টুর কাছে দিয়ে তিনি থানায় হারানোর জিডি করেন। হারুন বলেন, গ্যাস বাবু ও সাইদুল করিম মিন্টুকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে আমরা বিস্তারিত পরে জানাব। প্রয়োজনবোধে আবারও শিমুল ভুঁইয়াকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

এর আগে আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলায় মিন্টুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালত। গত ১১ জুন রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে মিন্টুকে আটক করে ডিবি। এর দুই দিন পর তাকে আদালতে হাজির করে রিমান্ডে নেওয়া হলো। এদিকে রিমান্ড শুনাতিতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে রিমান্ড শুনানির সময় বিচারক জিজ্ঞাসা করলে সাইদুল করিম মিন্টু বলেন, আমি নির্দোষ, আমি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। ৪৬ বছরের রাজনীতিতে আমার খুন-খারাবির কোনো রেকর্ড নেই। ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছি। এখন মনোনয়ন চাওয়াই আমার অপরাধ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমি ওয়ান ইলেভেনে গ্রেফতার হয়েছি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ১৩ বার গ্রেফতার হয়েছি। মানুষের জন্য রাজনীতি করেছি। কিন্তু আমাকে রাজনৈতিক কারণে ফাঁসানো হচ্ছে। উল্লেখ্য, গত ৬ জুন রাতে জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে ঝিনাইদহ শহরের আদর্শপাড়া এলাকা থেকে আটক করে ঢাকায় নিয়ে আসে ডিবির একটি দল। এরপর গত ৯ জুন তার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এ মামলায় গত ৩ জুন আসামি শিলাস্তি রহমান, ৪ জুন তানভীর ভুঁইয়া এবং ৫ জুন শিমুল ভুঁইয়া ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর গ্রেফতার নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা ও নানা বিতর্ক। তার অনুসারীরা মনে করছেন রাজনৈতিকভাবে ফাঁসানোর জন্য তাকে এমপি আনার হত্যাকান্ডে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ জন্য তারা প্রতিদিন বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও আনার অনুসারীরা তাদের প্রিয় নেতা হত্যায় মিন্টু জড়িত থাকায় প্রতিদিন তারাও উপজেলা শহরে বিক্ষোভ কর্মসূচি ও ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন করছেন। দুইপক্ষে চলছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। এদিকে আনার হত্যকান্ডে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিন্টু ও কাজী কামাল আহমেদ বাবুকে গ্রেফতারের পর আতঙ্কে আত্মগোপনে রয়েছেন ঝিনাইদহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা ও ঠিকাদারসহ ছয়জন। তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করেননি তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সর্বশেষ খবর