শিরোনাম
শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

কোরবানির পশু নিয়ে এ কোন বিলাসিতা!

♦ দাম হাঁকা হচ্ছে ১ থেকে ২ কোটি টাকা ♦ অধিক চর্বিযুক্ত প্রাণীতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বলছেন চিকিৎসকরা ♦ পশুদের খাবার নিয়েও প্রশ্ন ♦ লোকদেখানো হলে শরিয়তসম্মত হবে না-মত ইসলামী চিন্তাবিদদের

আরাফাত মুন্না

কোরবানির পশু নিয়ে এ কোন বিলাসিতা!

কোরবানির গরুর হাটে সবচেয়ে বড় গরুর দাম হাঁকানো হচ্ছে ১ কোটি টাকার বেশি। বিক্রেতাদের কেউ কেউ গরুর বাপদাদা চৌদ্দগোষ্ঠীর বংশ ইতিহাস শুনিয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছেন দাম। আবার সামাজিক প্রতিযোগিতায় অনেকে কোটি টাকা দামের গরুও কিনছেন। বাস্তবে এসব গরুর দাম কত তা কেউ নির্ধারণ করে দেয়নি। ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, বেশি দামে পশু কিনে লোকদেখানো কোরবানি দেওয়া শরিয়তসম্মত নয়। আবার বিশালদেহী  এসব গরু কোরবানির আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো জরুরি বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। অনেক সময়ই অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পশু মোটা-তাজাকরণ করা হয়। ফলে ওই সব গরুর মাংস খাওয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ বলে সতর্ক করেছেন চিকিৎসকরা।

জানা গেছে, ঈদের এক থেকে দেড় মাস আগেই গরু দ্রুত মোটাতাজা করার জন্য খামারিরা কিছু পল্লী চিকিৎসকের পরামর্শে বিভিন্ন নিষিদ্ধ ওষুধ ব্যবহার করছেন। কৃত্রিমভাবে গরুর মাংসপেশিতে ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে। এসব গরুর মাংস খেলে মানুষের কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত ও ক্যান্সারও হতে পারে বলে চিকিৎসকদের অভিমত।

ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বেশ কিছু জেলায় এবার এমন কিছু পশুর নজিরবিহীন দাম হাঁকা হচ্ছে, যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। সামাজিক মাধ্যম ও টেলিভিশন মিডিয়ায় বিভিন্ন বাহারি নাম দিয়ে এসব পশু কোরবানির জন্য কেনাবেচা হচ্ছে। আগের বছরগুলোতে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকায় গরু বিক্রি হলে সেটা দেশব্যাপী আলোচিত হতো। তবে এবার কোটি টাকায় একটি গরু বিক্রির কথা বলা হচ্ছে। রাজধানীতে সাদেক অ্যাগ্রো নামে একটি ফার্ম গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাহামা জাতের তিনটি গরু ২ কোটি ৬০ লাখ টাকায় বিক্রি করেছে। এর মধ্যে দুটি গরুর দামই ছিল ২ কোটি টাকা। বাকি একটি গরু বিক্রি হয় ৬০ লাখ টাকায়। সাদেক অ্যাগ্রোর দাবি, গরুগুলো শুধু মাংসের বিবেচনা নয়, বংশ ইতিহাস বিবেচনায় নিয়ে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।

শুধু রাজধানী ঢাকা নয়। ঢাকার বাইরে থেকেও বাহারি নামে বেশি দামে গরু বিক্রির খবর পাওয়া গেছে। চিত্রনায়ক শাকিব খান, জায়েদ খান, সালমান খান এবং চিত্রনায়িকা পরিমণির নামেও গরু বিক্রি হচ্ছে হাটগুলোতে। এ ছাড়া বাংলার রাজা, কালা মানিক, সুলতান, নবাব নামেও বেশি দামে গরু বিক্রির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে গরুর হাটগুলো থেকে। গরুর নাম বলিউড-ঢালিউডের নায়ক-নায়িকাদের নামে নামকরণ করে দাম হাঁকানো হচ্ছে আকাশছোঁয়া।

প্রাণী চিকিৎসক এবং পশু বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বিশালদেহী এসব দামি গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত বলে মন্তব্য করেছেন প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি  বলেন, কোটি টাকা দিয়ে কোরবানির গরু না কিনে ওই টাকা দিয়ে একাধিক গরু কিনে কোরবানি দিয়ে সেই মাংস গরিব লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া উচিত। শুধুমাত্র লোক দেখানো নাম কামানোর জন্য বেশি দামে পশু কোরবানি দেওয়া ঠিক হবে না। এতে কোরবানির আসল উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঈদুল আজহা উপলক্ষে অনেক খামারি গরু মোটাতাজাকরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করে থাকেন। এ পশুগুলো পরবর্তীতে কোরবানি করা হলে এবং এর মাংস মানুষ খেলে প্রয়োগ করা অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের শরীরেও যাবে। এর ফলে ওইসব মানুষের শরীরে অন্য কোনো অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না।  এ ছাড়া স্টেরয়েড মানুষের শরীরের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। এ ধরনের পশুর মাংস জনস্বার্থের জন্য হুমকি। তাই খামারিদের অনুরোধ করব গরু মোটাতাজাকরণের স্বাভাবিক পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করতে, যাতে মানুষ নিরাপদে গরুর মাংস খেতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. মাসুদার রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নামের সঙ্গে গরুর জাতের কোনো সম্পর্ক নেই। মূলত ভাইরাল হওয়ার জন্য এসব নাম দেওয়া হয়। এতে বেশি দামে গরু বিক্রির সুযোগ নেন বিক্রেতারা।  যেভাবে বিক্রেতারা দাম নির্ধারণ করেন, গরুর মাংসের সঙ্গে সেই দাম অসাঞ্জস্য। ১৪ শ কেজি ১৫ শ কেজি ওজন বলা হলেও এটা আসলে ভুয়া। আসলে তারা কেউ প্রকৃত ওজন জানে না।

অনেক বেশি দাম দিয়ে কোরবানির পশু ক্রয়ের বিষয়ে ইসলামি ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইবাদত হতে হবে লৌকিকতামুক্ত। সেটি যে কোনো ইবাদতই হোক না কেন। তবে ভালো নিয়তে কেউ যদি প্রতিযোগিতা করে সেটি অন্য কথা। কিন্তু মানুষকে দেখানোর জন্য, যশ-খ্যাতি লাভের জন্য, নিজের বড়ত্ব প্রকাশের জন্য কেউ যদি কোরবানি করে সেটি যথার্থ ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে না। তিনি বলেন, হজরত ইবরাহিম (আ.) এবং হজরত ঈসমাইল (আ.)-এর ওপর মহান আল্লাহর এত বড় পরীক্ষার এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যারা পালন করবেন তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ- কোরবানিকে লৌকিকতামুক্ত রাখুন। কোরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন-মরণ সবকিছুই একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য হবে। লোক দেখানোর জন্য নয়। ঢাকার চৌধুরীপাড়ার শেখ জনুরুদ্দীন (রহ.) দারুল কোরআন মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক মুফতি হুমায়ুন আইয়ুব বলেন, কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ইবাদতের মূলকথা হলো আল্লাহ তাআলার আনুগত্য এবং তার সন্তুষ্টি অর্জন। তাই যে কোনো ইবাদতের পূর্ণতার জন্য দুটি বিষয় জরুরি। ইখলাস তথা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পালন করা এবং শরিয়তের নির্দেশনা মোতাবেক মাসায়েল অনুযায়ী সম্পাদন করা। মানুষকে দেখানোর জন্য, লৌকিকতার জন্য কোরবানি করলে সেই কোরবানি আল্লাহ তায়ালার দরবারে কবুল হবে না। হাটবাজারে কোরবানির পশুর দামদর বা ফেসবুকে সেলফি তুলে নিজের মনের খায়েশ মেটানোর নাম কোরবানি নয়।

সর্বশেষ খবর